রূপান্তরিত মেঘা হতে চান বিমানবালা
সুবল শীল, ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের সঙ্গে উঠবস করতে স্বাছন্দ্যবোধ করতেন। ছেলে হয়েও খেলাধুলা খেলতেন পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে। মেয়েদের প্রতি ছিল তার আলাদা টান। শাড়ি, থ্রি-পিস পরা ছিল খুব আগ্রহ। সুযোগ পেলেই ঠোঁটে লিপস্টিক, হাতে চুড়ি আর মাথায় বেণি গাঁথতেন। চলাফেরা, কথাবার্তায় সমাজের কাছে শুনতে হতো নানা কটু কথা। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় অনেকেই হিজড়া বলে সম্বোধন করত তাকে।
এমনকি স্কুলে গিয়ে ছেলে বন্ধুদের চেয়ে মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বসতে ভালো লাগত তার। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি ছিল তার অন্য রকম আকর্ষণ। মনের ভাবনায় নিজেকে মেয়ে আর বাইরে ছেলে হিসেবেই চলতে হতো সুবলকে।
এভাবেই বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য এলাকা ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান তিনি। ঢাকায় পড়াশোনা করা অবস্থায় চিকিৎসা নিয়ে পুরুষ থেকে নারী (রূপান্তরিত) হন সুবল শীল। এরপর থেকে ‘মেঘা শর্মা’ নামে শুরু করেন নতুন জীবন।
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার ৫ নং সৈয়দপুর ইউনিয়নের থুমনিয়া গ্রামের জগেশ শীলের বড় সন্তান মেঘা শর্মা। তিনি জয়নন্দ এস সি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি সম্পন্ন করেন। ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল ল্যাবরেটরি কলেজ থেকে শেষ করেন এইচএসসি। এবার কবি নজরুল কলেজে রসায়ন বিভাগে অনার্স তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়ন করছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন তিনি।
সুবল থেকে মেঘা হয়ে গ্রামের বাসায় আসায় সৃষ্টি হয়েছে অন্য রকম পরিবেশ। মেঘাকে দেখার জন্য প্রতিনিয়ত বাসায় দেখা মিলে উৎসুক জনতার ভিড়। দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছে রূপান্তরিত শর্মাকে দেখতে।
মেঘা শর্মাকে দেখতে আসা পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা আবু মহসিন বলেন, আমি প্রথমে শুনে হতভম্ব হয়েছি। তারপর আজ তাকে দেখতে এলাম। শর্মা সম্পর্কে আমার ভাতিজা হয়। এখন থেকে সে আমার ভাতিজি। দুনিয়াটা কতটা আধুনিকায়ন হয়েছে, আমি এটাই ভাবছি। মানুষ কত কিছু করে ফেলছে এ যুগে।
ডাঙ্গীপাড়ার বাসিন্দা জিয়াউল হক বলেন, আমি ফেসবুকে দেখলাম এই গ্রামের একজন নাকি ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে গেছে। আমার বাড়ি এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। তাই দেখতে এসেছি। এসে দেখি আসলেই ছেলে থেকে এখন মেয়ে।
স্কুলশিক্ষার্থী সুমন বলে, আমি প্রাইভেট শেষ করে বাসায় যাচ্ছিলাম। শুনলাম যে একজন ছেলেমানুষ মেয়ে হয়ে গেছেন। তাই আমি দেখতে এলাম। তবে এটা কীভাবে সম্ভব, আমি এটাই ভেবে পাচ্ছি না।
সুবল থেকে মেঘা হওয়ার বিষয়টি পরিবার প্রথমে মানতে রাজি না হলেও এখন মেনে নিয়েছেন। ছেলে বা মেয়ে হিসেবে নয়, বরং সন্তান হিসেবে মেঘার পাশে থাকতে চান তার পরিবারের সদস্যরা।
মেঘার মা আলো রানী বলেন, আমার দুই ছেলে আর এক মেয়ে ছিল। এখন আমার দুই মেয়ে হয়ে গেল আর এক ছেলে। ছোটবেলা থেকেই সে মেয়েদের সঙ্গে মিশত, খেলাধুলা করত। আমরা বাধা দিতাম কিন্তু সে মানত না। সব সময় শাড়ি পরতে চাইত। পরে ঢাকায় পড়াশোনা করা অবস্থায় চিকিৎসা করে সে ছেলে থেকে মেয়ে হয়েছে। আমি জন্ম দেওয়া মা। তাকে তো আর ফেলে দিতে পারি না। অনেক দিন পর সে বাসায় এল। তাকে দেখার জন্য এখন লোকজন বাসায় ভিড় করছে।
মেঘার ছোট ভাই সবুজ শীল বলেন, সে আমার বড় ভাই ছিল। ছোটবেলা থেকে দেখতাম একটা ছেলে হয়েও সে আমাদের সাথে খেলাধুলা করত না। আমরা তাকে ক্রিকেট, ফুটবল বা অন্যান্য খেলার কথা বললেও সে খেলত না। সব সময় মেয়েদের মতো করে থাকার চেষ্টা করত। সে আমাকে দুই বছর আগে বিষয়টি অবগত করে। কিন্তু এখন সে একজন মেয়ে হিসেবে নিজেকে রূপান্তর করে।
এ ব্যাপারে মেঘা শর্মা বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমিও নিজেকে ছেলে হিসেবে মনে করতাম। কিন্তু আমার কাছে আমাকে আলাদা রকম মনে হতো। যেখানে ছেলেরা ক্রিকেট, ফুটবল খেলাধুলা করত, তার চেয়ে মেয়েদের সাথে খেলতে আমার ভাল লাগত। বয়ঃসন্ধিকালে যখন একটা ছেলে একটা মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতো, সেখানে আমি আমার ছেলে বন্ধুদের প্রতি, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি আকৃষ্ট হতাম। সব সময় সাজসজ্জা করে থাকতে খুব ভালো লাগত। পরিবার ও সমাজ বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি প্রথমে। অনেকে আমাকে কটু কথা বলে আঘাত করত। কিন্তু আমার খারাপ লাগলেও স্বভাবে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
কার মাধ্যমে চিকিৎসা নিয়েছেন, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, পরবর্তীতে আমি ঢাকায় পড়াশোনা করার জন্য যাই। সেখানে গিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে জানতে পারি চিকিৎসা নিয়ে মেয়ে হওয়া সম্ভব। আমি তাদের সাথে যোগাযোগ করে চিকিৎসা নিই। এখন আমি পুরোপুরি মেয়ে হিসেবে সুস্থ আছি।
তিনি আরও বলেন, আমি ঢাকায় অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছি। পড়াশোনা শেষ করে আমি এয়ার হোস্টেজ হতে চাই। আমি মডেলিং করতে আগ্রহী। আমার মতো যারা রূপান্তরিত নারী, আমি তাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকতে চাই।
অনেক মানুষেই আমাদের নিয়ে নানা কথা বলে। আমি তাদের ভুল শোধরাতে চাই। আমি আমার দেশের মানুষের মাঝে প্রমাণ করে দিতে চাই আমরা সমাজ ও দেশের বোঝা নই। বরং আমরাও দেশের নাগরিক ও সম্পদ। এ দেশকে আমরাও ভালোবাসি আর দেশের জন্য কিছু করতে চাই।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন