ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের চলমান উত্তেজনার মধ্যে ক্রেমলিনকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখার জন্য জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। হুমকি-ধমকি দিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে থামাতে চাইছেন জো বাইডেন। ইউক্রেনে হামলা হলে রাশিয়াকে চড়া মূল্য দিতে হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন তিনি। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের এত মরিয়া প্রচেষ্টার কারণ কী, তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন।
প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা হলে রাজনৈতিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বাইডেন। তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে তাঁর শক্তিমত্তা ও সাহস নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আর সর্বোপরি দেশটির মধ্যবর্তী নির্বাচনের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান গত রোববার আশঙ্কা জানিয়েছেন, রাশিয়া যেকোনো সময় ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে। সিএনএনের স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপক জ্যাক ট্যাপারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুলিভান বলেন, যেভাবে রাশিয়া তাদের বাহিনী মোতায়েন করেছে, মহড়া চালিয়েছে, তাতে বলা যায়, শিগগিরই বড় ধরনের সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে তারা।
সুলিভান জানান, ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা ছোড়ার মধ্য দিয়ে হামলা শুরু হতে পারে। আর তাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
সুলিভান বলেন, ‘রাশিয়া যদি অগ্রসর হয়, তবে আমরা ন্যাটোভুক্ত অঞ্চলগুলোকে সুরক্ষা দেব। এর জন্য রাশিয়াকে মূল্য চুকাতে হবে। আমরা নিশ্চিতভাবেই তা করে দেখাব। কারণ, ৩০ বছর আগের তুলনায় পশ্চিমা বিশ্ব এখন অনেক শক্তিশালী, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং অনেক বেশি ফলপ্রসূ। সামরিক পদক্ষেপের জন্য রাশিয়াকে শেষ পর্যন্ত উল্লেখজনকভাবে কৌশলগত মূল্য চুকাতে হবে।’
ইউক্রেনকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য দেশটিতে সরাসরি সেনা পাঠাবে না যুক্তরাষ্ট্র। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ইউক্রেন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশ নয়। সুতরাং রাশিয়া ও মার্কিন সেনাদের মধ্যে সরাসরি সংঘাত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে প্রতিবেশী দেশ রোমানিয়া ও পোল্যান্ডে সেনা মোতায়েন রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। একসময় আয়রন কারটেনের (লোহার পর্দা) মধ্যে থাকা পোল্যান্ড ও রোমানিয়া এখন ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র। আয়রন কারটেন হলো ইউরোপকে দুটি আলাদা অঞ্চলে বিভক্তকারী রাজনৈতিক সীমারেখার নাম। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি থেকে ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এ আয়রন কারটেন ছিল।
পররাষ্ট্রনীতির ওপর প্রভাব
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক নীতিমালার ওপর প্রভাব পড়তে পারে। জনগণ নিজেরাই নিজেদের নেতাকে বেছে নেবে, এমন নীতির ওপর ভিত্তি করেই দশকের পর দশক ধরে পররাষ্ট্র নীতিমালা পরিচালনা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। সিএনএনের প্রতিবেদনে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ঘটনা চীনকে তাইওয়ানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুপ্রাণিত করবে। আর চীন এমনটা করলে বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। আর তা হবে ইউক্রেনে রুশ অভিযানের চেয়ে বড় যুদ্ধ। তবে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রকে দেশের অভ্যন্তরীণ ধাক্কা সামলাতে হবে সবার আগে। যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়বে। আর তাতে আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাইডেন ও তাঁর ডেমোক্রেটিক পার্টির ওপর এর প্রভাব পড়বে।
গত রোববার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ রাশিয়াকে ‘দ্রুত ও সন্দেহাতীতভাবে’ সাজা দেবে। তবে এ ধরনের পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে পাল্টে দিতে পারে। আর তা বাইডেনের জন্য আরেকটি সংকট তৈরি করবে।
৩০ বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো দুই বড় পারমাণবিক শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি এ ক্ষেত্রে রুশদের শাস্তি কিংবা হত্যার মতো পদক্ষেপ নেয়, তবে উত্তেজনা আরও বাড়বে। কংগ্রেসে কেউ কেউ আহ্বান জানিয়েছেন, ১৯৮০–এর দশকে আফগানিস্তান থেকে মস্কোকে তাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে অর্থায়ন করেছিল, সেই একই কায়দায় ইউক্রেনের বিদ্রোহীদেরও অর্থায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জবাব দেওয়ার ক্ষমতা রাশিয়ার রয়েছে। বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিতে ব্যাঘাত ঘটানোর সক্ষমতাও রয়েছে দেশটির।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা হলে তেলের মূল্য বেড়ে যেতে পারে। আর তা যুক্তরাষ্ট্রের গাড়িচালকদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক হবে। গ্যাসের উচ্চ মূল্যের কারণে ইতিমধ্যে বাইডেনের জনপ্রিয়তা কমতে দেখা গেছে। আমেরিকান অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গ্যাসের গড় মূল্য ৩ দশমিক ৪৮ ডলার। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ১৯৮২ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতির হার এটি।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের ওপর প্রভাব
রিপাবলিকানরা ইতিমধ্যে বাইডেনকে দুর্বল ব্যক্তি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। প্রমাণ করতে চাইছে, ইউক্রেনে রুশ হামলা ঠেকাতে পুতিনকে রাজি করাতে পারছেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শনিবার ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, আফগানিস্তান থেকে তাড়াহুড়ো করে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘটনা থেকেই যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানানোর অনুপ্রেরণা পেয়েছেন পুতিন। ট্রাম্পের দাবি, তিনি হলে এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে পুতিনকে বিরত রাখতে পারতেন। তিনি বলেন, ‘আমি তাঁকে ভালো করে চিনি। তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমরা একে অপরকে শ্রদ্ধা করি।’
ট্রাম্প দাবি করেছেন, তাঁর ক্ষমতাকালীন প্রশাসনের মতো করে অন্য কোনো মার্কিন প্রশাসনই রাশিয়ার বিরুদ্ধে এতটা কঠোর হতে পারেনি।
ট্রাম্পের এসব বক্তব্য ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইউক্রেনে রাশিয়া অভিযান চালালে বাইডেনের বিরুদ্ধে রিপাবলিকানরা কেমন প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে বাইডেনকে দুর্বল ও অযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করে নিজেদের পক্ষে প্রচার চালানোর সুযোগ পাবে রিপাবলিকান শিবির। তারা বোঝাতে চাইবে, ট্রাম্পের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলেছে বিশ্ব।
শনিবার পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপের সময় তাঁকে সতর্ক করেছেন বাইডেন। রাশিয়া যদি ইউক্রেনে আক্রমণ করে, তাহলে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। তবে সিএনএনের প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয়েছে, বারবার দেওয়া এসব সতর্কতার কারণে বাইডেনের জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, পুতিন যদি এসব হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে ইউক্রেনে অভিযান শুরু করে দেন, তখন বিতর্কের মুখে পড়তে পারেন বাইডেন। কিছু করতে না পারার অভিযোগ উঠতে পারে তাঁর বিরুদ্ধে।
করোনা মহামারিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাস ও মৌলিক প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতিকে বাইডেনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা হিসেবে উপস্থাপন করতে চায় রিপাবলিকানরা। এমন অবস্থায় ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা হলে বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রচারণার সুযোগ পাবে তারা।
বাইডেনের জনপ্রিয়তার ওপর প্রভাব
গত সপ্তাহে প্রকাশিত সিএনএন/এসএসআরএস প্রকাশিত এক নতুন জরিপে দেখা গেছে, বাইডেনের জনপ্রিয়তা কমে ৪১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনে রুশ হামলা হলে সংকট আরও বাড়তে পারে। মার্কিন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যেসব প্রেসিডেন্ট এ ধরনের সংকটে পড়েছেন, তাঁরা প্রথম মেয়াদের মধ্যবর্তী নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন।
জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে সিএনএন পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৪৫ শতাংশ ডেমোক্রেটিকপন্থী ও ডেমোক্রেটিক–সমর্থক ভোটার ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বাইডেনকে আবারও দেখতে চান। ৫১ শতাংশ চান, অন্য কাউকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হোক।
ট্রাম্পের জন্য এর চেয়ে ভালো খবর আর হতে পারে না। ৫০ শতাংশ রিপাবলিকানপন্থী ও রিপাবলিকান–সমর্থক ভোটার চান, ট্রাম্প আবারও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে দল থেকে মনোনয়ন পান। রিপাবলিকানদের মধ্যে বিকল্প প্রার্থী চান ৪৯ শতাংশ মানুষ।
এমন অবস্থায় এখন বাইডেন যদি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো মিত্রদের ঐক্যবদ্ধ করতে সফল প্রচেষ্টাও চালান এবং ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে কঠোর শাস্তিও দেন, তারপরও তিনি ভোটারদের খুব একটা আকর্ষণ করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। বরং পুতিন যদি শেষ মুহূর্তে এসে হামলা না করেন এবং ইউক্রেন সীমান্ত থেকে সেনাদের সরিয়ে নেন, তাহলে মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাইডেন প্রচার করতে পারবেন যে শক্তিমত্তার কারণে রাশিয়া পিছু হটেছে। তবে পুরোদমে হামলা না করলেও ইউক্রেনের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে চাইবেন পুতিন। আর তাঁর এমন পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্র ও বাইডেনের মাথাব্যথার কারণ হয়েই থাকবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন