বৈধ আয়ের পাশাপাশি অবৈধ অর্থের গন্তব্য হিসেবেও সুইস ব্যাংকের পরিচিতি বিশ্বজোড়া। বড় বড় ব্যাংক কঠোরভাবে তাদের গ্রাহকদের তথ্য গোপন রাখে। এবার প্রকাশ পেল বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতা ও সাবেক সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের জমানো ‘গোপন সম্পদ’-এর তথ্য। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক ‘ক্রেডিট সুইস’-এর ফাঁস হওয়া নথি এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামনে এনেছে।
সুইস ব্যাংকটিতে গোপনে অর্থ-সম্পদ জমাকারী ব্যক্তিদের তালিকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের নাম রয়েছে। এর মধ্যে আছেন পাকিস্তানের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) সাবেক প্রধান আখতার আবদুর রহমান, ইয়েমেনের রাজনৈতিক নিরাপত্তা সংস্থার (পিএসও) সাবেক প্রধান গালিব আল-কামিশ, জর্দানের জেনারেল ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেটের (জিইডি) সাবেক কর্মকর্তা সাদ আল-খাইর। তালিকায় রয়েছেন জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ, তাঁর দুই ছেলে এবং মিসরের সাবেক একনায়ক প্রয়াত হোসনি মুবারকও। প্রতিবেদনে বলা হয়, মুবারকের ছয় ব্যাংক হিসাবের একটিতে ২২ কোটি ৪০ লাখ ডলারেরও বেশি জমা ছিল।
বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত ব্যক্তিরা ‘বিভিন্ন অনৈতিক পন্থা অবলম্বন’ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভূ-কৌশলগত ভূমিকা কাজে লাগিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমিয়েছিলেন।
সুইস ব্যাংকের ৩০ হাজার ব্যক্তির ব্যক্তিগত, যৌথ ও করপোরেট ১৮ হাজার অ্যাকাউন্টের তথ্য ফাঁস হয়েছে। ফাঁস হওয়া অ্যাকাউন্টে সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। এসব অ্যাকাউন্ট চল্লিশের দশকের পর, ২০০০ সালের পর এবং বেশ কিছু গত দশকে খোলা হয়। এমনকি বেশ কিছু এখনো সচল রয়েছে।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ‘সুইটডয়চে সেইটুং’কে একজন অজানা ‘তথ্য ফাঁসকারী (হুইসেলব্লোয়ার)’ এসব তথ্য সরবরাহ করেন। বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন অর্গানাইজিং ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) এবং দ্য গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ বিশ্বের ৫০টি সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা এসব তথ্য পর্যবেক্ষণ করে ‘সুইস সিক্রেটস’ শিরোনামে একযোগে প্রকাশ করেছেন। সেই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমগুলো এসব ব্যক্তির সম্পদ অর্জনের কৌশলও প্রকাশ করে।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর জার্মান সংবাদমাধ্যমটির পক্ষে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা বিশ্বাস করি, সুইস ব্যাংকিংয়ের গোপনীয়তা আইন অনৈতিক। গোপনীয়তা রক্ষার অজুহাত অনৈতিক কাজ ঢেকে রাখার কৌশল, যা অপরাধীদের সহযোগী হিসেবে সুইস ব্যাংকের লজ্জাজনক ভূমিকা আড়াল করে রাখে। ’
তবে ক্রেডিট সুইস গণমাধ্যমের দাবি প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিয়ে বলেছে, পর্যালোচনা করা অ্যাকাউন্টগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ এখন বন্ধ অথবা গণমাধ্যমের অনুসন্ধানের আগে বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিল, যার মধ্যে ২০১৫ সালের আগে ৬০ শতাংশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারা আরো বলে, এই প্রতিবেদনগুলো শুধু ব্যাংকই নয়, সামগ্রিকভাবে সুইস আর্থিক বাজারকে অবমূল্যায়ন করার সমন্বিত চেষ্টা বলে মনে হচ্ছে, যা গত কয়েক বছর ধরে চলছে।
প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রক্রিয়ারও বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আফগানিস্তানে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বাহিনীর দখলদারির সময় মার্কিন বাহিনী মুজাহিদদের মদদ দিয়ে ছায়াযুদ্ধ চালিয়েছিল। সে প্রক্রিয়ায় পাকিস্তান, জর্দান, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন মিত্র দেশ কিভাবে ওয়াশিংটনকে সহযোগিতা করেছে তার বিশদ বিবরণ উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। নেপথ্যের শীর্ষ ব্যক্তিরা কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হন, আছে তার বর্ণনাও।
আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান আখতার আব্দুর রহমান
সত্তরের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সাতটি মুজাহিদ গোষ্ঠীকে মদদ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ সময় সুইস ব্যাংকের মাধ্যমে মার্কিন বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) ও সৌদি আরবের মধ্যে আর্থিক লেনদেন হতো। এসব অর্থ শেষমেশ আখতার আব্দুর রহমানের অ্যাকাউন্টে জমা হতো। তাঁর দুই ছেলে আকবর ও হারুন খানের ক্রেডিট সুইসের অ্যাকাউন্টে ৩৭ লাখ ডলার জমা হয়েছিল।
ইয়েমেনের পিএসওপ্রধান গালিব আল-কামিশ
প্রতিবেদনে বলা হয়, সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে মুজাহিদদের মদদ দিতে আইএসআইয়ের আখতার আব্দুর রহমানের যে ভূূমকা ছিল ইয়েমেনে আলি-কামিশের ভূমিকা ছিল তার অনুরূপ। ইয়েমেনের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আলি আব্দুল্লাহ সালেহের ‘ব্ল্যাক বক্স’ অর্থাৎ গোপন খবরের ভাণ্ডার ছিলেন আল-কামিশ। পরে তাঁদের সম্পর্ক খারাপের দিকে যায়। রাজনৈতিক নিরাপত্তা সংস্থায় (পিএসও) কাজ করা পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক গোয়েন্দাদের ভাষ্য, ‘লাখ লাখ ডলারের খোলা বাজেট’ ছিল কামিশের জন্য, যা দিয়ে তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারতেন। সিআইএর হয়ে তিনি ইয়েমেনে সন্দেহভাজন আটক ব্যক্তিদের গোপন কারাগার বানিয়েছিলেন। বিনিময়ে পেয়েছিলেন বিপুল অর্থ। বর্তমানে তুরস্কে বাস করছেন আলি-কামিশ।
জিআইডিপ্রধান সাদ আল-খাইর
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একবার দাবি করেছিল, সাদ আল খায়েরের নেতৃত্বাধীন জর্দানের গোয়েন্দা সংস্থা জিআইডি সিআইএর ‘প্রক্সি জেলার’ হিসেবে কাজ করেছে। সিআইএ যেসব সন্দেহভাজনকে প্রচারের আলোয় আসতে দিতে চাইত না, তাদের জিআইডির কারাগারে পাঠানো হতো। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ১৪ জন বন্দির তথ্য নথিভুক্ত হয়েছে, যাদের সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র জিআইডির কাছে পাঠিয়েছিল। সুইস ব্যাংকে সাদ খাইরের একটি অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছিল দুই কোটি ১৬ লাখ ডলার। জিআইডি কমপক্ষে ১০০ জনের কাছ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করেছে।
এর বাইরেও সাংবাদিকরা বেশ কয়েকটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করা আরো কমপক্ষে ৪০ জনের নাম পেয়েছেন, যাঁদের সুইস ব্যাংকে অর্থ ছিল। এর মধ্যে আছেন ভেনিজুয়েলার সাবেক সেনাপ্রধান ক্যাপ্টেন কার্লোস লুই অ্যাগুলেরা বোর্হেস (হুগো শাভেজের সাবেক দেহরক্ষী), ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান ভ্যালেরি খোরশকোভস্কি (বর্তমানে ধনকুবের) এবং জার্মানি, নাইজেরিয়া, উজবেকিস্তান ও ইরাকের অনেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের এক জামাতার কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সূত্র : বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, ওসিসিআরপি
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন