অনেক আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক আর টানাপোড়েনের পর অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে জাস্টিন ল্যাঙ্গার অধ্যায়ের আপাতত সমাপ্তি। অস্ট্রেলিয়ার প্রধান কোচের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করলেন সাবেক এই ওপেনার।
ল্যাঙ্গারের ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ‘ডিএসইজি’ শনিবার সকালে এক বিবৃতিতে জানায় এই সিদ্ধান্ত।
“ডিএসইজি নিশ্চিত করছে যে, আমাদের মক্কেল জাস্টিন ল্যাঙ্গার অস্ট্রেলিয়ার ছেলেদের ক্রিকেট দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব থেকে আজকে পদত্যাগ করেছে। গত রাতে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এক সভার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তটি কার্যকর এই মুহূর্ত থেকেই।”
ল্যাঙ্গারের ম্যানেজার জেমস হেন্ডারসন, যিনি রিকি পন্টিং, টিম পেইন ও ক্যামেরন গ্রিনেরও ম্যানেজার, পরে টুইটারে নিজে আরেকটি বিবৃতি দিয়ে নিশ্চিত করেন সিদ্ধান্ত। ল্যাঙ্গার তখন ছিলেন মেলবোর্ন থেকে পার্থে যাওয়ার পথে।
ল্যাঙ্গারের সঙ্গে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চুক্তি ছিল আগামী জুন পর্যন্ত। তবে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে আলোচনা চলছিল কিছুদিন ধরে। গত অক্টোবরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও গত মাসে অ্যাশেজ জয়ের পর ল্যাঙ্গারের চাওয়া ছিল লম্বা সময়ের জন্য মেয়াদ বাড়ানো। কিন্তু হলো উল্টো।
ল্যাঙ্গারের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া বিবৃতিতে জানায়, ল্যাঙ্গারকে আর কিছুদিন দায়িত্বে থাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
“জাস্টিনের বর্তমান চুক্তির সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। দুঃখজনকভাবে তিনি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।”
ল্যাঙ্গারের মেয়াদ বৃদ্ধির সেই প্রস্তাবিত সময়ে অক্টোবর-নভেম্বরে দেশের মাঠে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও ছিল বলে জানায় বোর্ড। কিন্তু স্বল্প মেয়াদের প্রস্তাব মনে ধরেনি ল্যাঙ্গারের।
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার পরিচালকরা মেলবোর্নে ম্যারাথন এক সভায় বসেন শুক্রবার। ৮ ঘণ্টার সেই সভায় মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ল্যাঙ্গারের চুক্তি। গত মাসে অ্যাশেজ শেষ হওয়ার পর এই তিন সপ্তাহে চুক্তি নিয়ে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী নিক হকলি ও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলের প্রধান বেন অলিভারের সঙ্গে দফায় দফায় সভা হয় ল্যাঙ্গারের।
শুক্রবারের সভা শেষে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া বিবৃতিতে জানায়, ল্যাঙ্গারের সঙ্গে একান্তে আলোচনা চলছে তাদের এবং আলোচনার ফলাফল জানানো হবে শিগগিরই। বোর্ডের এই বিবৃতির পরদিন সকালেই এলো ল্যাঙ্গারের পদত্যাগের ঘোষণা।
এই ঘটনাপ্রবাহ থেকেই অনেকটা পরিষ্কার, দায়িত্বে থেকে যেতে চাইলেও পরিস্থিতির কারণে পদত্যাগের পথে হাঁটতে অনেকটা বাধ্য হলেন ল্যাঙ্গার। সেটির মূল কারণ, কোচিংয়ের ধরন নিয়ে সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে যা নিয়ে আলোচনা চলছে গত প্রায় এক বছর ধরে।
গত বছর ভারতের কাছে দেশের মাঠে সিরিজ হারার পর থেকেই ল্যাঙ্গারের কোচিংয়ের ধরন নিয়ে সিনিয়র ক্রিকেটারদের অসন্তোষের ব্যাপারটি প্রকাশ্য হতে থাকে। সংবাদমাধ্যমে তুমুল আলোচনার জন্ম দেয় যা। পরে গতবছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও বাংলাদেশে সীমিত ওভারের সিরিজের পর পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ে। ড্রেসিং রুমে ও মাঠের বাইরে ল্যাঙ্গারের কিছু আচরণ, কিছু পরিস্থিতি সামলানোর ধরন এবং তার ‘ম্যান ম্যানেজমেন্ট’ নিয়ে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে ক্রিকেটারদের মধ্যে।
বাংলাদেশ থেকে দেশে ফেরার পর গত অগাস্টের শেষ দিকে কোয়ারেন্টিনে থাকার সময়টায় কোচের সঙ্গে জরুরি সভায় বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন সেই সময়ের টেস্ট অধিনায়ক টিম পেইন, তখনকার সহ-অধিনায়ক ও এখনকার টেস্ট অধিনায়ক প্যাট কামিন্স ও সীমিত ওভারের অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ।
ওই সভার পর নিজের কোচিংয়ের ধরন পাল্টাতে সম্মত হন ল্যাঙ্গার। নিজে একটু আড়ালে থেকে সহকারী কোচদের সামনে রাখা ও ক্রিকেটারদের ওপর বেশি নির্ভরতার সিদ্ধান্ত হয় আলোচনায়। ক্রিকেটারদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে এবং নিজের ধরনের সঙ্গে আপোস করা নিয়ে তখন ৩০টিরও বেশি জুম মিটিং করেন ল্যাঙ্গার। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াও তখন জানায়, বিশ্বকাপ ও অ্যাশেজে ল্যাঙ্গারকে সময় দিচ্ছেন তারা।
এরপর ফেভারিটদের কাতারে না থেকেও প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপ জয়ের পর সিনিয়র ক্রিকেটারদের কয়েকজন বলেন, এই সাফল্য মূলত এসেছে ক্রিকেটারদের নিজেদের তাড়নায় ও প্রেরণায়।
বিশ্বকাপ থেকে দেশে ফেরার পর অ্যাশেজেও ‘ডে টু ডে’ কোচিং থেকে দূরে সরে একটু আড়ালে থেকে ‘রিল্যাক্সড’ কোচিংয়ের ধরন ধরে রাখেন ল্যাঙ্গার। এবারও মেলে সাফল্য, ইংল্যান্ডকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়ে অ্যাশেজ ধরে রাখে অস্ট্রেলিয়া।
পিঠেপিঠি এই সাফল্য ও কোচিংয়ের ধরনে পরিবর্তনের পর ল্যাঙ্গার আশা করছিলেন চুক্তির মেয়াদ দীর্ঘমেয়াদে বাড়ার। কিন্তু সিনিয়র ক্রিকেটারদের, বিশেষ করে সাদা ও লাল বলের অধিনায়ক ফিঞ্চ ও কামিন্সের নানা মন্তব্যে প্রতিফলন পড়েনি কোচের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের। কামিন্স তো প্রকাশ্যেই বলেন, ল্যাঙ্গারের চুক্তির মেয়াদ মূল্যায়ন করা উচিত।
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার ভাবনাও যে ক্রিকেটারদের সঙ্গে এক স্রোতে মিশেছে, তার প্রমাণ ল্যাঙ্গারের পদত্যাগে। ল্যাঙ্গারের চুক্তি নিয়ে দুই অধিনায়ক কামিন্স ও ফিঞ্চের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন প্রধান নির্বাহী হকলি। সেই কথোপকথনের প্রতিবেদনও উপস্থাপন করা হয় বোর্ডে। সবকিছুর প্রেক্ষিতেই ল্যাঙ্গার বুঝে যান করণীয়। শেষ হয় কোচ হিসেবে তার চড়াই-উৎরাইয়ের অধ্যায়।
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ভীষণ সঙ্কটের সময়ে ২০১৮ সালে কোচের দায়িত্ব নেন ল্যাঙ্গার। কেপ টাউনে বল টেম্পারিং কাণ্ডে তখন টালমাটাল দল। ল্যাঙ্গারের শুরুটাও হয় প্রচণ্ড বাজে। ইংল্যান্ডে সীমিত ওভারের সিরিজে সব ম্যাচ হারে তারা। প্রথম টেস্ট সফর সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাকিস্তানের বিপক্ষে এক টেস্টে উসমান খাওয়াজার বীরত্বে ড্র করতে পারলেও আরেকটিতে হেরে সিরিজও হারতে হয়।
পরে দেশে ফিরে ভারতের কাছেও টেস্ট সিরিজ হারে অস্ট্রেলিয়া, যা ছিল দেশের মাঠে প্রথমবার এশিয়ার কোনো দলের কাছে তাদের সিরিজ হার। ক্রিকেটারদের সঙ্গে তার বিভেদের রেখা ফুটে ওঠে সেখান থেকেই।
পরে ল্যাঙ্গারের কোচিংয়ে দলের ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু ওয়ানডে দিয়ে। ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জয়, পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করার পর ২০১৯ বিশ্বকাপে খুব আশা না নিয়ে গিয়েও সেমি-ফাইনাল খেলে অস্ট্রেলিয়া। পরে ওই বছর ইংল্যান্ডে অ্যাশেজও ধরে রাখতে পারে তারা।
২০২০ সালে নিউ জিল্যান্ড ও পাকিস্তানকে উড়িয়ে টেস্টের র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে উঠে যায় অস্ট্রেলিয়া। পরে টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়েও প্রথমবারের মতো এক নম্বরে ওঠে তারা।
কিন্তু গত বছর আবার তারা দেশের মাঠে সিরিজ হারে ভারতের কাছে। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও বাংলাদেশ সফরের বিপর্যয় দিয়ে প্রশ্ন উচ্চকিত হতে থাকে তার ড্রেসিং রুম সামলানোর ধরন নিয়ে।
শেষ পর্যন্ত সেটাই কাল হলো তার জন্য। পরিসংখ্যানে তিনি জন বুকাননের পর অস্ট্রেলিয়ার সফলতম কোচ। কিন্তু ড্রেসিং রুম সামলানোর প্রশ্নবিদ্ধ সামর্থ্য তাকে ঠেলে দিল পদত্যাগের পথে।
অস্ট্রেলিয়ার পকিস্তান সফরের আর এক মাসও নেই। আপাতত ভারপ্রাপ্ত প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করবেন সহকারী কোচ অ্যান্ড্রু ম্যাকডোনাল্ড। পাকিস্তান সফরের আগে দেশেই ৫ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ আগামী শুক্রবার থেকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। এই সিরিজে ল্যাঙ্গারকে আগেই বিশ্রাম দিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় ম্যাকডোনাল্ডকে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন