দুদিনের জোর গুঞ্জনে সবকিছু প্রায় নিশ্চিতই মনে হচ্ছিল। অপেক্ষা ছিল কেবল আনুষ্ঠানিক ঘোষণার। অশ্রুসিক্ত চোখে সের্হিও আগুয়েরো জানালেন, সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে তার পক্ষে আর ফুটবল খেলা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে তাই বললেন, বিদায়।
কাম্প নউয়ে বুধবার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বুটজোড়া তুলে রাখার ঘোষণা দেন আগুয়েরো। ১৮ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের ইতি টানার লগ্নে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি ৩৩ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড।
“শারীরিকভাবে ভালো থাকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎকরা আমাকে বলেছেন যে, খেলা বন্ধ করাই সবচেয়ে ভালো হবে। আর তাই আমি বার্সা ছেড়ে যাচ্ছি এবং ফুটবল থেকে বিদায় নিচ্ছি।”
নতুন স্বপ্ন নিয়ে গত গ্রীষ্মের দলবদলে ম্যানচেস্টার সিটি ছেড়ে ফ্রি ট্রান্সফারে বার্সেলোনায় যোগ দেন আগুয়েরো। নতুন ঠিকানায় শুরুতেই ধাক্কা খান তিনি, ছিটকে পড়েন চোট পেয়ে।
অবশ্য ওই চোট কাটিয়ে দ্রুতই বার্সেলোনার শুরুর একাদশে জায়গা করে নেন এই আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার। দলটির হয়ে লা লিগায় চারটি এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগে একটি ম্যাচ খেলেন তিনি। গোলের খাতাও খোলেন তিনি; একমাত্র গোলটি তিনি করেন ক্লাসিকোয় বদলি হিসেবে নেমে।
বিপত্তিটা বাঁধে গত ৩০ অক্টোবর লা লিগায় আলাভেসের বিপক্ষে বার্সেলোনার ১-১ ড্র ম্যাচে; হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করায় মাঠ ছেড়ে যান আগুয়েরো। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে, হৃদযন্ত্রের স্পন্দন জটিলতা সংক্রান্ত অ্যারিথমিয়া রোগে ভুগছেন তিনি।
ওই সময়ই তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে বলে গুঞ্জন ওঠে। স্পেনের মার্কা ও আর্জেন্টিনার টিওয়াইসি স্পোর্টসসহ কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে তখন বলা হয়, অসুস্থতার কারণে আগেভাগে বুটজোড়া তুলে রাখতে হতে পারে আগুয়েরোকে।
তবে বার্সেলোনার পক্ষ থেকে তিন মাস পর আগুয়েরোর মাঠে ফেরার সম্ভাবনার কথা বলা হয়। ক্লাবটির কোচ হিসেবে যোগ দিয়ে গত মাসে ওই সব খবরকে গুজব বলে উড়িয়ে দেন শাভি এরনান্দেস। বলেন, আগুয়েরোর মাঠে ফেরার অপেক্ষায় আছেন তিনি।
তবে সব আশাই নিরাশায় রূপ নিল। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী কাম্প নউয়ে হাজির হন আগুয়েরো। শুরুতে মনের কষ্ট চেপে রাখতে পারেননি তিনি, কেঁদে ফেলেন। একটু পরই নিজেকে সামলে নেন। শোনান, রোগ ধরার পড়ার পর থেকে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ের কথা।
“এই কনফারেন্স ডাকা হয়েছে এটা জানানোর জন্য যে, আমি ফুটবল খেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খুব কঠিন মুহূর্ত।”
“ক্লিনিকে আমার শরীরে প্রথম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা আমাকে ডেকে বললেন, জোর সম্ভাবনা আছে যে আমি হয়তো আর খেলা চালিয়ে যেতে পারব না। ওই মুহূর্ত থেকেই আমি নিজেকে (আজকের দিনের জন্য) একটু একটু করে প্রস্তুত করেছি, কিন্তু এটা সহজ ছিল না। চিকিৎসকদের মধ্যে একজন আমাকে সরাসরি বলেছিলেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে’।”
এরপরই পুরনো দিনের কথা বলেন আগুয়েরো। ফুটবল স্বপ্নে বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন।
“সবাইকে বলতে চাই যে, আমি সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করেছি। পাঁচ বছর বয়স থেকে এবং ফুটবলে প্রথম স্পর্শের পর থেকে আমি ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখেছি। কখনও ভাবিনি যে ইউরোপে খেলতে পারব। কোথায় কোথায় অনুশীলন করেছি সেটা বিষয় নয়, সবার প্রতিই আমি কৃতজ্ঞ।”
শৈশবের ক্লাব ইন্দিপেনদিয়েন্তেই সিনিয়র ক্যারিয়ার শুরু হয় আগুয়েরোর। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সেখানে খেলে ওই বছরই ইউরোপে পাড়ি জমান তিনি, যোগ দেন আতলেতিকো মাদ্রিদ। স্পেনের দলটির হয়ে ২৩৪ ম্যাচে করে ১০১ গোল, জেতেন ২০১০ সালের ইউরোপা লিগ।
এরপর ২০১১ সালে ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দিয়ে কাটান ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফল অধ্যায়। এখানে ১০ বছরের ক্যারিয়ারে পাঁচটি প্রিমিয়ার লিগ, একটি এফএ কাপ ও ছয়টি লিগ কাপ জেতেন তিনি। গড়েন দলটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড; ৩৯০ ম্যাচে ১৬ হ্যাটট্রিকসহ করেন ২৬০ গোল।
সব মিলিয়ে ক্যারিয়ারে ৭৮৬ ম্যাচে ৪২৭ গোল করা আগুয়েরোর কণ্ঠে বিদায়বেলায় ছিল সন্তুষ্টির ছোঁয়াও।
“মাথা উঁচু রেখেই আমি বিদায় নিচ্ছি। আমি খুশি। জানি না, পরবর্তী জীবনে আমরা জন্য কী অপেক্ষা করছে। জানি, অনেক মানুষ আমাকে ভালোবাসে এবং আমার জন্য সর্বোচ্চ ভালোটাই চায়।”
দেশের ফুটবলেও বেশ সফল আগুয়েরো। তিনটি বিশ্বকাপে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা এই ফরোয়ার্ড আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে মোট ১০১ ম্যাচ খেলে করেছেন ৪১ গোল। গত জুন-জুলাইয়ে কোপা আমেরিকা জয়ের মধ্য দিয়ে আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের শিরেপা খরা ঘোচানোর অভিযানেও ছিলেন তিনি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন