বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যমান বন্ধুত্বকে আরও সুসংহত করার বার্তা দিয়েছেন সফররত ভারতের প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ অভিন্ন বার্তা দেন। সরকার প্রধানের সঙ্গে আলোচনায় যেকোনো প্রয়োজনে বরাবরের মতো ভারত বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন দেশটির রাষ্ট্র প্রধান। ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতের প্রেসিডেন্ট বুধবার সকালে ঢাকা আসেন। প্রথম দিনটি তিনি সিরিজ কর্মসূচিতে কাটিয়েছেন। এদিনের তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি ছিল প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক। বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টায় রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ভারতের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশের সরকার প্রধান। সন্ধ্যায় বৈঠক হয় দুই প্রেসিডেন্টের।
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে সহায়তা কামনা: ওদিকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সহায়তা চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন। এ ছাড়া আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের সমস্যাগুলো নিরসনের অনুরোধ করা হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী। বুধবার ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এ কথা জানান।
রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। বৈঠক শেষে ড. আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে বলেছি, ভারতের সঙ্গে আমাদের গত ৫০ বছরের সুসম্পর্ক রয়েছে। আমরা একে অপরকে সহায়তা করেছি, করছি। আগামী ৫০ বছরও একে অপরকে সহায়তা করে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে চাই। তিনি বলেন, করোনাকালে আমাদের উনারা সহায়তা করেছেন, সেজন্য আমরা উনাদের ধন্যবাদ জানিয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী, মুজিববর্ষের সমাপনী এবং দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতের প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফর করছেন।
শেখ হাসিনার জন্য মিষ্টি ও কেক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য উপহার হিসেবে মিষ্টি, কেক আর বিস্কুট নিয়ে এসেছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, যা তৈরি হয়েছে তারই বাসভবনে। শেখ হাসিনা বুধবার বিকালে রাজধানীর একটি হোটেলে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তাকে এই উপহার দেন কোবিন্দ। এর আগে ‘সুস্বাদু ও মিষ্টি’ আম উপহার পাঠানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগে রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। পরে সাংবাদিকদের সামনে বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরেন তারা।
প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, গতবার আম পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ভারতের রাষ্ট্রপতি বলেছেন, সেগুলো খুব সুস্বাদু, ও মিষ্টি ছিল। প্রধানমন্ত্রীর জন্য উনি উনার রাষ্ট্রপতি ভবনে নিজেদের তৈরি করা মিষ্টি, কেক এবং বিস্কুট নিয়ে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী যেন নিজে সেগুলো গ্রহণ করেন, সেই অনুরোধ তিনি করেছেন।
বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা উনাকে বলেছি, আমাদের দু’দেশের মধ্যে যে সোনালী অধ্যায়, সেটা অন্যান্য দেশের জন্য অনুকরণীয়। আমরা সব ধরনের বড় বড় সমস্যা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করেছি। আমি বলেছি, আগামী ৫০ বছরে বিভিন্ন দিকে মিউচুয়ালি একে অপরকে সাহায্য করে আমরা সবাই উন্নতির শিখরে পৌঁছাবো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের ‘অভাবনীয় সাফল্যের’ কথাও আলোচনায় স্থান পেয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমাদের কানেক্টিভিটির কথা আমরা তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, ভারতের সঙ্গে আমাদের গভীর সম্পর্ক। এই সম্পর্কের ফলেই এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অব্যাহতভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের কোঅপারেশন এই রিজিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং আরও অনেক দূর যাবে। গরিবি হটানোতে আমাদের দু’দেশের কোঅপারেশন আরও দরকার।
শাহরিয়ার আলম বলেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে যাওয়ায় তাকে ধন্যবাদ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন: বুধবার দুপুরে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে দেখে তিনি জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
জাদুঘরের কিউরেটর এন আই খান গণমাধ্যমকে জানান, দুপুর সোয়া ১টার দিকে সেখানে পৌঁছান ভারতের রাষ্ট্রপতি। বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা তাকে জাদুঘরে স্বাগত জানান এবং ঘুরিয়ে দেখান বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। এ সময় উপহার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’সহ কয়েকটি বই ভারতের রাষ্ট্রপতির হাতে তুলে দেন শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে দেখার পর পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী ও মুজিববর্ষের আয়োজনে যোগ দিতে তিনদিনের সফরে বুধবার সকালে ঢাকায় পৌঁছান তিনি। এয়ার ইন্ডিয়া ওয়ান ফ্লাইটে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সেখানে ভারতীয় রাষ্ট্রপতিকে গালগালিচা সংবর্ধনা ও গার্ড অব অনার দেয়া হয়। এরপর সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ধানমণ্ডিতে যান কোবিন্দ।
স্মৃতিসৌধে রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গে তার স্ত্রী ভারতীয় ফার্স্ট লেডি সবিতা কোবিন্দ ও তাদের মেয়ে স্বাতী কোবিন্দ ছাড়াও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।
বিমানবন্দরের ভিভিআইপি টার্মিনালে ২১ বার তোপধ্বনি দিয়ে রামনাথ কোবিন্দকে স্বাগত জানানো হয়। তিন বাহিনীর সুসজ্জিত একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার দেয়। দেয়া হয় লাল গালিচা সংবর্ধনা। গার্ড পরিদর্শনকালে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে লাইন অব প্রেজেন্টেশনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
আজ ও কালকের কর্মসূচি: সফরের দ্বিতীয় দিন আজ (১৬ই ডিসেম্বর) জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ভারতের প্রেসিডেন্ট ‘গেস্ট অব অনার’ হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় দিবসের সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্?যাপন অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। এরপর বিকালে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর ঐতিহাসিক মুহূর্তে ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, স্পিকারসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ অংশ নিবেন। সফরের তৃতীয় দিন (১৭ই ডিসেম্বর) ভারতের প্রেসিডেন্ট ঢাকার রমনাস্থ কালীমন্দিরে যাবেন। সেখানে সদ্য সংস্কারকৃত অংশের উদ্বোধন এবং মন্দির পরিদর্শন করবেন। মন্দির সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত মতবিনিময়ের আগ্রহও রয়েছে তার। রমনা থেকে ফিরে দুপুরেই দিল্লির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করবেন রামনাথ কোবিন্দ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন