আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও রাবার বুলেট ছুড়ে ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদকে দুই ঘণ্টা পর মুক্ত করেছে পুলিশ।
এ ঘটনায় রাতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। আজকের মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের। এ নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিলো। পুলিশ ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে মহিলা পুলিশ কনস্টেবলসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের পদত্যাগসহ চার দফা দাবিতে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আন্দোলন করে আসছিলেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকাল ৩টার দিকে শিক্ষার্থীরা এম ওয়াজেদ মিয়া আইসিটি ভবনের ভেতরে ভিসিকে অবরুদ্ধ করে রাখে। অবরোধের পর থেকে তারা আইসিটি ভবনের ফটকে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এদিকে- সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে পুলিশ বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিতে লাঠিচার্জ চালায়। আইসিটি ভবনের ফটকের কাছে ঘেরাও করে শিক্ষার্থীদের পেটায় পুলিশ। এ সময় শিক্ষার্থীরা পাল্টা ইটপাটকেল ছুড়লে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষের সময় পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে রাবার বুলেট ছুড়ে। এতে শিক্ষার্থীরা আইসিটি ভবনের সামনে থেকে পিছু হটলে পুলিশি পাহারায় ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমদকে তার বাসভবনে পৌঁছে দেয়া হয়। এরপর থেকে ভিসি বাসভবনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছে- পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ, রাবার বুলেটের আঘাতে অন্তত ২০-২৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছে।
রাবার বুলেটে আহত কয়েকজনকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ সময় এম্বুলেন্সে করে গুরুতর আহত এক মহিলা পুলিশ কনস্টেবলকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সংঘর্ষের পুলিশের ডিসি আজবাহার আলী শেখ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম, ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক জহির উদ্দিন আহমদ, শিক্ষার্থী সজল কুণ্ডও আহত হন।
ক্যাম্পাসে উপস্থিত থাকা ছাত্রলীগ কর্মীরা জানিয়েছে- পুলিশের লাঠিচার্জের সময় তাদের কয়েকজনও আহত হয়েছেন। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার আজবাহার শেখ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- শিক্ষার্থীরা পুলিশের ওপর হামলা চালালে পুলিশও পাল্টা লাঠিচার্জ ও রাবার বুলেট ছুড়ে। এতে পুলিশের কয়েকজন সদস্য গুরুতর আহত হন। এ ঘটনার পর ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে- শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন- পুলিশ দিয়ে ছাত্র পিটিয়ে ভিসি তার বাস ভবনে গেছে। অতীতে কোনো ভিসি এ ধরনের ঘটনার জন্ম দেননি। ঘটনায় আহতদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের পাশাপাশি চার দফা দাবিতে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। শাবির দ্বিতীয় হল বলে পরিচিত বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী ছাত্রী হল। এই হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক জাফরিন আহমদ করোনা আক্রান্ত হয়ে বাসায় রয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে হল প্রভোস্টের পদত্যাগ, হলের ভেতরে নানা অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা দূর করা ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন হল প্রভোস্ট নিয়োগ করাসহ তিন দফা দাবিতে কনকনে শীত উপেক্ষা করে বিক্ষোভ শুরু করে ওই হলের ছাত্রীরা। প্রথমে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বর এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করলেও ওই রাতে ভিসির বাসভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করে।
রাত আড়াইটার দিকে ভিসি বেরিয়ে এসে পরদিন গত শুক্রবার আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিলে ছাত্রীরা ভোররাতে হলে ফিরে। শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যস্ত ছাত্রীদের একাংশ গিয়ে ভিসির সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ছাত্রীরা তাৎক্ষণিক দাবি মেনে নেয়ার দাবি জানালেও ভিসি সময় চান। ফলে আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় গত শুক্রবার দুপুর থেকে সিরাজুন্নেছা হলের শিক্ষার্থীরা ফের বিক্ষোভ শুরু করে। ওইদিন সন্ধ্যায় ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে ছাত্রীরা হলে ফিরে যায়।
কিন্তু আল্টিমেটামের মেয়াদ গত শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় শেষ হলেও শিক্ষার্থীদের দাবি মানা হয়নি। এ কারণে গত শনিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে ফের বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে ছাত্রীরা। এ সময় তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের বেশকিছু ছাত্র এসে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে একটি এম্বুলেন্স বাইরে বের হওয়াকে কেন্দ্র ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি; ছাত্রলীগ কর্মীরা তাদের মারধর করেছে। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে হেনস্তারও অভিযোগ করা হয়। এ ঘটনার পর তিন দফা দাবিকে চার দফায় রূপান্তরিত করে গত শনিবার রাত ১টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে।
তাদের দাবির শেষ দফা হচ্ছে; আন্দোলনে হামলাকারী ছাত্রলীগ কর্মীদের বিচার দাবি। রাত ১টার দিকে শিক্ষার্থীরা গতকাল ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে হলে ফিরে। এদিকে- গতকাল সকাল হতেই বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী হলের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বর এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে।
শতাধিক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের গোলচত্বরের প্রবেশমুখে অবস্থান করার কারণে ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে কোনো যানবাহন বের হতে পারেনি কিংবা প্রবেশ করতে পারেনি। এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেক বিভাগে ক্লাস ও পরীক্ষা হয়েছে। আর ছাত্রী বিক্ষোভের কারণে প্রায় অর্ধেক বিভাগে কোনো ক্লাস ও পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি। দুপুরের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক তুলশী কুমার দাস বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের কাছে এসে দাবি মেনে নেয়ার জন্য এক সপ্তাহের সময় চাইলে ছাত্রীরা সে দাবি মানেনি।
আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা এম ওয়াজেদ মিয়া আইসিটি ভবনের ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে ভিসিকে অবরুদ্ধ করে রাখে। একপর্যায়ে তারা ফটকে তালাও ঝুলিয়ে দিয়েছে। শতাধিক ছাত্রী ভিসিকে ওই ভবনের ভেতরে রেখে বাইরে বিক্ষোভ করে। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে কয়েকজন শিক্ষক গিয়ে আইসিটি ভবনের কলাপসেবল ফটক খুলতে চাইলে শিক্ষার্থীরা বাধা প্রদান করে।
শিক্ষকরা ভেতরে ঢুকতে চাইলে তাদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিসি ভবনের ভেতরেই অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন- যেহেতু হল প্রভোস্ট করোনা আক্রান্ত, সে কারণে আমরা ছাত্রীদের কাছ থেকে বিষয়টির সুরাহা করার জন্য এক সপ্তাহের সময় চেয়েছিলাম।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা সে দাবি মানেনি। তিনি বলেন- দাবি একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে মেনে নিতে হয়। এই সময়ও দিচ্ছে না ছাত্রীরা। এদিকে- ভিসি অবরুদ্ধ হওয়ার পর ক্যাম্পাসে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্যরা বিক্ষোভ স্থল, আইসিটি ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছে।
অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েনের কথা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাদের সামনেই বিক্ষোভ চলছিলো শিক্ষার্থীদের। সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীরা জানিয়ে দিয়েছে- ঘোষিত চার দফা দাবি মেনে নিলে তারা হলে ফিরবে। নতুবা ক্যাম্পাসে আন্দোলন চালিয়ে যাবে। যতই বাধা আসুক তারা আন্দোলনে থাকবে বলে জানায়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন