নতুন বছরের প্রথম দিন আগের ২৪ ঘণ্টায় (১ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত) ৩৭০ জন নতুন করোনা রোগী শনাক্তের তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেদিন নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তে হার ছিল দুই দশমিক ৪৩ শতাংশ।
একই সময়ে চার জনের মৃত্যুর কথাও জানানো হয়। আর তিন সপ্তাহ শেষে গতকাল রবিবার (২৩ জানুয়ারি) অধিদফতর জানিয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় (২৩ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত) নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৯০৬ জনের। এ সময়ে শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ। আর এ সময়ে ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের।
অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ১ জানুয়ারিতে দেশের ৪৪ জেলায় নতুন রোগী শনাক্ত ছিল না। বাকি জেলাগুলোর মধ্যে কেবলমাত্র ঢাকা জেলা ছাড়া বাকিগুলোতে রোগী ছিল এক অংকের সংখ্যায়। আর ২৩ জানুয়ারিতে অধিদফতর জানাচ্ছে, ৬৪ জেলার মধ্যে মাত্র পাঁচ জেলায় এক অংকের ঘরে রোগী শনাক্ত হয়েছে।
বাকি জেলাগুলোর মধ্যে চার অংকের সংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়েছে দুই জেলায় আর তিন অংকের সংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়েছে আট জেলায়। বাকি জেলাগুলোতে রোগী সংখ্যা দুই অংকের ঘরে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। পরের বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিন জন ভাইরাসটিতে শনাক্ত হওয়ার কথা জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এর ঠিক ১০ দিন পর করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর কথাও জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
এরপর প্রায় দুই বছর ধরে চলা এ মহামারির সংক্রমণচিত্রে বিভিন্ন সময়ে ওঠানামা চিত্র দেখেছে দেশ। তবে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা দেখা গিয়েছে বছরের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে।
করোনার ধরন ডেল্টার তাণ্ডবে সেসময়ে দেশ একদিনে সর্বোচ্চ রোগী আর সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছে। তবে আগস্টের শেষ দিকে এসে সংক্রমণ কমতে শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। শনাক্তের হার কমে আসে ১ শতাংশের কাছাকাছি। তবে বছর শেষে নতুন ত্রাসের জন্ম দেয় করোনার অতিসংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন।
ডেল্টার তুলনায় পাঁচ থেকে ছয়গুণ বেশি সংক্রমণ ক্ষমতা নিয়ে ওমিক্রন ছড়াতে থাকে বাতাসের গতিতে। আর চলতি বছরের মধ্য জানুয়ারি থেকে সংক্রমণ ফের ঊর্ধ্বমুখী। গত কয়েকদিন ধরেই পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।
দেশে একদিনে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ভয়ংকর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডবের সময়। সে বছরের ২৪ জুলাই অধিদফতর জানায়, তার আগের ২৪ ঘণ্টায় করোনাতে রোগী শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। যা কিনা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। আর গত ২৪ ঘণ্টায় (২৩ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত) শনাক্তের হার হার ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের জায়গা একটু একটু করে নিচ্ছে ওমিক্রন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম (২৩ জানুয়ারি) অধিদফতরের ভার্চুয়াল বুলেটিনে জানিয়েছেন, ‘দেশে এখনও করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রাধান্য বেশি, তবে একটু একটু করে সে জায়গাটা ওমিক্রন দখল করে নিচ্ছে।’
দেশে ওমিক্রনের সামাজিক সংক্রমণ বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওমিক্রন আগের সব রেকর্ড ভাঙ্গবে। আর গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার এখনই চলে এসেছে ডেল্টার চূড়ার কাছাকাছি।
সেইসঙ্গে প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদফতর যে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা জানাচ্ছেন সেটাও প্রকৃত সংখ্যা নয়, বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ‘ওমিক্রনে ডেল্টার মতো জটিলতা নেই বলা হলেও সামনে আরও মৃত্যু বাড়বে।’
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সংক্রমণ বাড়লে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যাও আনুপাতিক হারে বাড়বে।
বর্তমানে যে মৃত্যুগুলো হচ্ছে সেগুলো আগের প্রভাব, নিদেনপক্ষে তিন সপ্তাহ আগে যারা আক্রান্ত হয়ে জটিল অবস্থায় গিয়েছে, সেসব রোগীদের মৃত্যু হচ্ছে। আর বর্তমান সময়ে যেসব রোগীদের অবস্থা জটিল অবস্থায় গিয়েছে তাদের মৃত্যুর অবস্থা দেখা যাবে আগামী তিন সপ্তাহ পর।
আগামী কয়েক সপ্তাহ ধরে যদি এভাবে মৃত্যু বাড়তে থাকে, তাহলে সেসব মৃত্যু ওমিক্রনে সংক্রমিত হয়েই হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে জানিয়ে মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘যদি দেখা যায় শনাক্তের হারের তুলনায় মৃত্যু কম হচ্ছে তাহলেই কেবল বলা যাবে ওমিক্রনে মৃত্যু। আর আগ পর্যন্ত কিছু বলা সম্ভব হবে না।
তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, শনাক্ত যদি অনেক বেড়ে যায় তাহলে আনুপাতিক হারে মৃত্যু বাড়বে।’
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সংক্রমণের যে ঊর্ধ্বগতি রয়েছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারি ১১ দফা নির্দেশনা ঠিক আছে, কারণ সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া সমাধান নয়, সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া একদম শেষ ব্যবস্থা।’
তবে সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পাশাপাশি মানুষকে সম্পৃক্ত করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিতে হবে বলে মনে করেন ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ডেল্টার প্রাদুর্ভাবের সময় কিন্তু করোনা প্রতিরোধের জন্য একেবারে ওয়ার্ড পর্যায়েও কমিটি করার প্রজ্ঞাপন দিয়েছিল ক্যাবিনেট। যেখানে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সবাই ছিল। যেখানে করোনাকে প্রতিরোধ করার কাজ করার পাশাপাশি টিকার জন্যও কাজ করা হতো।
সেই নির্দেশনা গ্রামে কিছুটা হলেও শহরে একদমই বাস্তবায়ন হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শহরে এটা বাস্তবায়ন করার জন্য সিটি মেয়রদের কাজ করতে হবে, তারা যেন উদাহরণ তৈরি করেন। ২০২০ সালে যখন জোনাল লকডাউন হয়েছিল, তখন তারা বেশ সক্রিয় ছিলেন। সেভাবেই এখন আবার কাজ করতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য ও জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, এখনও হাসপাতালে বেড ফাঁকা রয়েছে। কিন্তু আগামী তিন থেকে চার সপ্তাহ পরে হাসপাতালগুলোতে শয্যা কতোটা ফাঁকা থাকবে- সেটা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়।
সংক্রমণের এই ঊধর্ধ্বগতিতে বাণিজ্যমেলা, শপিংমল খোলা রাখার বিষয়টিকে ‘বিক্ষিপ্ত এবং এলোপাতাড়ি পরিকল্পনা’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখানে সমন্বিত এবং চিন্তা করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন