কী চায় রাশিয়া? পশ্চিমাদের স্বার্থই বা কী? | What does Russia want? What is the interest of the West?


ইউক্রেনকে ঘিরে ইউরোপে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এর একদিকে আছে রাশিয়া, যারা ইউক্রেনের সীমান্তে প্রায় লাখখানেক সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে বলে দাবি করছে পশ্চিমা দেশগুলো। এর পাল্টা ন্যাটো জোটও তাদের সামরিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। 

ইউক্রেনে কোনো অভিযান চালালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ব্যবস্থার হুমকি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা।

গত কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম ইউরোপ আবার একটি বড় আকারের যুদ্ধের মুখোমুখি - এমন আশংকা করছেন অনেকে।

কিন্তু ইউক্রেনকে ঘিরে এই উত্তেজনা এবং সংঘাত আসলে কেন? রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন আসলে কী চান? ন্যাটো জোট কী করছে? ইউক্রেন সংকট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর :

রাশিয়া কি সত্যিই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে?

রাশিয়া বার বার জোর গলায় এমন কোনো পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করছে যে তারা ইউক্রেনে একটি যুদ্ধ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তবে রাশিয়া আগেও ইউক্রেনের সীমানা দখল করেছে। এই মুহূর্তে তাদের প্রায় এক লাখ সৈন্য ইউক্রেনের সীমান্তের কাছে মোতায়েন আছে বলে মনে করা হচ্ছে। রাশিয়া বহুদিন ধরেই চেষ্টা করছে, ইউক্রেন যাতে কোনোভাবেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে না যায়।

তাদের আরো আপত্তি ন্যাটো জোট নিয়ে। ইউক্রেন এখনো ন্যাটো জোটের সদস্য নয়। কিন্তু পূর্ব ইউরোপের আরো অনেক সাবেক কমিউনিস্ট দেশের মতো, ইউক্রেনও সেই পথে চলেছে বলে মনে করছে রাশিয়া।

এই মুহূর্তে সেখানে তীব্র সামরিক উত্তেজনা রয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে পশ্চিমা দেশগুলো যদি তাদের আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি না বদলায়, তাহলে ‘যথাযথ পাল্টা সামরিক-কারিগরি’ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল মনে করেন, একটা সংঘাতের বাস্তব সম্ভাবনা আছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বাস করেন, রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র বলছে, রাশিয়া কেন ইউক্রেন সীমান্তের কাছে এত সৈন্য পাঠিয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা তারা দেয়নি। বেলারুশেও রাশিয়ার সৈন্যরা যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা, রাশিয়া এ বছরের প্রথম ভাগেই কোনো এক সময়ে ইউক্রেনে ঢুকবে।

রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বর্তমান সংকটকে কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সাথে তুলনা করেছেন। ১৯৬২ সালের সেই সংকটের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায় একটি পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিল।

ইউক্রেনকে ঘিরে এই সংঘাতের শুরু কখন থেকে?

যদি সাম্প্রতিক ইতিহাসের কথা বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে ২০১৪ সালে - যদিও এই সংকটের আসল কারণ বুঝতে হলে যেতে হবে আরো পেছনে- সোভিয়েত আমলে, যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল।

পূর্ব ইউরোপের আরো কিছু কমিউনিস্ট দেশ এবং সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মতো, ইউক্রেনেও দুটি রাজনৈতিক ধারা বেশ স্পষ্ট।

একটি অংশ চায় পশ্চিম ইউরোপের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে এবং নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হতে। অপর অংশ রুশ প্রভাব বলয়ে থাকার পক্ষপাতী, কারণ ইউক্রেনের জনসংখ্যার বিরাট অংশ রুশ ভাষাভাষী, তারা জাতিগতভাবেও রুশ। রাশিয়ার সাথে তাদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক যোগাযোগ।

২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন বিক্ষোভের মুখে। এরপর তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়।

প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে চেয়েছিলেন। তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে মাখামাখি করছিলেন, কিন্তু আবার মস্কোকেও ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখিয়ে চলেছিলেন। কিন্তু তারপরও প্রেসিডেন্ট পুতিন তাকে সহ্য করেছেন।

কিন্তু যখন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে এক বিশাল বাণিজ্য চুক্তি করতে চাইলেন - যা প্রকারান্তরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া - তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করলেন।

এরপর যখন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বাণিজ্যচুক্তির আলোচনা ভেঙে বেরিয়ে এলেন, তখন তার বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। তার পতনের পর যারা ক্ষমতায় আসে, তারা এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়, যা প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ক্ষুব্ধ করে।

ইউক্রেনের ভেতরে যে রুশ অধ্যুষিত অঞ্চল, সেখানে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হলে মস্কো তাদের সমর্থন দেয়। এই বিদ্রোহীদের সমর্থনে এরপর রুশ সৈন্যরা হস্তক্ষেপ করে, এক পর্যায়ে ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে সেটি নিজেদের দেশের অংশ বলে ঘোষণা করে রাশিয়া।

কিন্তু রাশিয়া কেন ক্রিমিয়া নিজের সীমানাভুক্ত করলো?

রাশিয়া এক বিরাট দেশ - বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ - ১১টি টাইম জোন জুড়ে যেটি বিস্তৃত। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ। ভারতের পাঁচগুণ। ব্রিটেনের চেয়ে ৭০ গুন বড়। কিন্তু দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ১৪ কোটি ৪০ লাখ। বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া বা পাকিস্তানের চেয়েও কম।

এত বড় একটি দেশের ক্রিমিয়া দখল করে নিজের সীমানাভুক্ত করার কী দরকার ছিল, এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।

রাশিয়া যত বড় দেশই হোক, তাদের একটাই সমস্যা - সারা বছর সচল রাখা যায় উষ্ণ পানির এমন গুরুত্বপূর্ণ বন্দর তাদের প্রায় নেই বললেই চলে। ক্রিমিয়ার সেভাস্তাপোলে রাশিয়ার যে নৌঘাঁটি, সেটি কৌশলগত কারণে তাই রাশিয়ার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাল্টিক সাগরে রাশিয়ার ঢোকার পথ হচ্ছে এই বন্দর। সেটি হাতছাড়া হতে তারা কোনোভাবেই দিতে চায়নি।

প্রায় ২০০ বছর ধরে ক্রিমিয়া কিন্তু রাশিয়ারই অংশ ছিল।

ক্রিমিয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষও জাতিগত রুশ। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ এটি হস্তান্তর করেন তৎকালীন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের কাছে। তখন তারা ভাবেননি, কোনো একদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবে এবং ক্রিমিয়ার ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাবে।

কাজেই ইউক্রেন যে ন্যাটোর সদস্য হবে, সেটা রাশিয়া কোনোভাবেই মানবে না। কিন্তু মস্কো যখনই দেখলো যে ইউক্রেন তাদের প্রভাবের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন সেখানে হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেন।

লেখক-সাংবাদিক টিম মার্শালের মতে, কোনো বৃহৎ শক্তির অস্তিত্ব যখন হুমকিতে পড়ে, তখন সে শক্তি প্রয়োগ করবেই। এটা হচ্ছে কূটনীতির এক নম্বর শিক্ষা।

তিনি তার একটি বই ‘প্রিজনার্স অব জিওগ্রাফি’ বইতে লিখেছেন, ‘আপনি হয়তো এরকম একটা যুক্তি দিতে পারেন যে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সামনে বিকল্প ছিল। তিনি ইউক্রেনের ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারতেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে প্রেসিডেন্ট পুতিন আসলে রাশিয়ার ঈশ্বর প্রদত্ত ভৌগোলিক হাত নিয়ে খেলছেন এখানে।’

‘কাজেই ইউক্রেনের ব্যাপারে কিছু না করে বসে থাকার কোনো সুযোগ তার ছিল না। কারণ ক্রিমিয়া ছিল রাশিয়ার একমাত্র উষ্ণ পানির বন্দর, আর পুতিনের আমলেই এই বন্দর রাশিয়ার হাতছাড়া হবে, সেটা তিনি চাননি।’

রাশিয়া নিজেকে এখনো দেখে একটি পরাশক্তি হিসেবে, এবং বিশ্বে তার সেই সামরিক-রাজনৈতিক শক্তি অটুট রাখার ক্ষেত্রে ক্রিমিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব তাই অনেক।

যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর কাছে রাশিয়ার দাবি কী?

ইউক্রেন এখনো ন্যাটোর সদস্য নয়। তবে তাদের সাথে ন্যাটোর সখ্যতা আছে। ভবিষ্যতে কোনো একদিন তারা ন্যাটো জোটের সদস্য হবে, এরকম একটা বোঝাপড়া আছে। তবে রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে এরকম একটা নিশ্চয়তা চায়, যেন এটা কখনোই না ঘটে।

কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো এরকম নিশ্চয়তা দিতে রাজি নয়।

ইউক্রেনের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ জাতিগতভাবে রুশ। তাদের সাথে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আছে। রাশিয়া কৌশলগতভাবে ইউক্রেনকে তার বাড়ির পেছনের আঙ্গিনা বলে বিবেচনা করে।

প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন, পশ্চিমা শক্তি আসলে ন্যাটো জোটকে ব্যবহার করে চারিদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলছে। তিনি চান ন্যাটো যেন পূর্ব ইউরোপে তাদের সামরিক তৎপরতা কমিয়ে আনে।

তিনি বহুদিন ধরে অভিযোগ করে যাচ্ছেন যে ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটকে পূর্বদিকে সম্প্রসারণ করা হবে না বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটি তারা রাখেনি। তবে ন্যাটো রাশিয়ার এই কথা প্রত্যাখ্যান করেছে।

তারা বলছে, ন্যাটো জোটের মাত্র অল্প কটি দেশের সাথে রাশিয়ার সীমান্ত রয়েছে, আর ন্যাটো হচ্ছে একটি আত্মরক্ষামূলক সামরিক জোট। অনেকের বিশ্বাস, ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়ার যে বিরাট সৈন্য সমাবেশ, তার উদ্দেশ্য আসলে রাশিয়ার নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়গুলো যাতে পশ্চিমারা গুরুত্বের সাথে নেয়, সেজন্য বাধ্য করা।

তবে ইউক্রেনকে ন্যাটো সামরিক জোটে ঢুকতে না দেয়ার যে দাবি রাশিয়া জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তা নাকচ করে দিয়েছে। রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে, তখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন রাশিয়ার কাছে পাঠানো এক আনুষ্ঠানিক জবাবে একথা জানিয়েছেন।

ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জেন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, তাদের সামরিক জোটের জবাবও মস্কোর কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, রাশিয়ার উদ্বেগের বিষয়গুলো তিনি শুনতে রাজি আছেন, কিন্তু এটাও বুঝতে হবে প্রত্যেকটি দেশের তার মতো করে নিজের প্রতিরক্ষার পথ বেছে নেয়ার অধিকার আছে।

রাশিয়ার মতো সামরিক শক্তি কেন নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন?

ব্রিটিশ সাংবাদিক টিম মার্শাল তার লেখা বেস্টসেলার ‘প্রিজনার্স অব জিওগ্রাফি’ বইতে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

তিনি লিখেছেন, অনেক ভাবতে পারেন রাশিয়ার মতো এত বড় একটি সামরিক ক্ষমতাধর দেশকে কে আক্রমণ করতে চাইবে। কিন্তু রাশিয়া নিজে বিষয়টি সেভাবে দেখে না। এর যথেষ্ট ভিত্তিও আছে। গত ৫০০ বছরে রাশিয়া বহু বিদেশী শক্তির আক্রমণের মুখে পড়েছে, আর এই সবগুলো আক্রমণই এসেছে উত্তর ইউরোপের সমতল ভূমি দিয়ে।

১৬০৫ সালে পোলিশরা আক্রমণ চালিয়েছিল এই পথ ধরে। এর পরে আসে সুইডিশরা। ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে হামলা চালায় ফরাসীরা। জার্মানরা রাশিয়ায় অভিযান চালিয়েছে দুবার - ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, আবার ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।

১৮১২ সালে নেপোলিয়নের সময় থেকে হিসাব করলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ে প্রতি ৩৩ বছরে রাশিয়াকে উত্তর ইউরোপের সমতলভূমিতে একবার করে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কাজেই রাশিয়ার ধারণা, তাদের দেশের জন্য কোনো নিরাপত্তা হুমকি যদি থেকে থাকে, সেটি এই পথেই আসবে।

১৯৯০ এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ভেঙ্গে গিয়েছিল, সেটিকে প্রেসিডেন্ট পুতিন রাশিয়ার জন্য এক ভূরাজনৈতিক বিপর্যয় বলে মনে করেন। এরপর থেকে রাশিয়া কেবল উদ্বেগের সাথে দেখছে, কীভাবে ধীরে ধীরে সামরিক জোট ন্যাটো চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলছে।

১৯৯৯ সালে চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড যোগ দিল ন্যাটোতে। ২০০৪ সালে তাদের পথ অনুসরণ করলো বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়া। ২০০৯ সালে যোগ দিল আলবেনিয়া।

এই দেশগুলো এক সময় হয় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ অথবা ওয়ারশ সামরিক জোটের সদস্য।

জর্জিয়া, মলদোভা বা ইউক্রেনও পারলে ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কারণেই তাদের যোগ দেয়া হয়নি। কারণ এই তিনটি দেশেই রুশপন্থী মিলিশিয়াদের শক্ত অবস্থান আছে। এই দেশগুলোর যেকোনো একটি যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তা রাশিয়ার সাথে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করতে পারে।

টিম মার্শাল লিখেছেন, গত শতকে স্নায়ুযুদ্ধের দিনগুলোতে কে ভাবতে পেরেছিল মস্কো থেকে মাত্র কয়েক শ’ মাইল দূরে পোল্যান্ডের মাটিতে বা বাল্টিক দেশগুলোতে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা থাকবে?

তার মতে, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেয়া মানে যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর সামরিক বাহিনী একেবারে রাশিয়ার পেটের ভেতরে এসে অবস্থান নেয়া। নিজের দোরগোড়ায় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতিকে রাশিয়া সঙ্গত কারণেই এক বিরাট নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।

ইউক্রেন সংকটে রাশিয়ার গ্যাস কেন বড় ইস্যু?

পরমাণু অস্ত্রের কথা বাদ দিলে, রাশিয়ার হাতে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র কিন্তু তার সেনাবাহিনী বা বিমান বাহিনী নয়। রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তার জ্বালানি।

ইউরোপের মোট তেল ও গ্যাস সরবরাহের ২৫ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া, ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়ার মতো দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানির ওপর শতভাগ নির্ভরশীল।

জার্মানির প্রায় অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ আসে রাশিয়া থেকে। জার্মানির রাজনীতিকরা কেন রাশিয়ার সমালোচনায় অতটা সরব নয়, এ তথ্য থেকেই তা বোঝা যায়।

আর ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেন হচ্ছে রাশিয়ার প্রবেশ দ্বার। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপ লাইনগুলো গেছে ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে। রাশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ যায় এই পাইপলাইন দিয়ে।

কাজেই ইউক্রেন যদি রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের বাইরে চলে যায়, তাহলে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে পারে বলে আশংকা করে।

তবে ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে জার্মানি পর্যন্ত নর্ড স্ট্রিম-২ নামে নতুন একটি গ্যাস পাইপলাইন বসিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া যদি ইউক্রেনে অভিযান চালায়, তাহলে এই নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প আর সামনে আগাবে না বলে এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইউরোপ যেভাবে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, তাতে করে রাশিয়া অন্যান্য দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে যাবে বলে আশংকা করে যুক্তরাষ্ট্র।

তারা মনে করে, রাশিয়া চাইলে যেকোনো সময় এসব গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে, সামনের দিনগুলোতে এই জ্বালানিকে একটা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে বার বার ব্যবহার করতে পারে।

ইউক্রেন প্রশ্নে ন্যাটো কি ঐক্যবদ্ধ?

প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেন প্রশ্ন ইউরোপীয় নেতারা সবাই একমত। তবে বিভিন্ন দেশ যে ধরনের সমর্থন দেবে বলে কথা দিচ্ছে, তার মধ্যে পার্থক্য আছে।

যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা ইউক্রেনে ৭০ টনের মতো ‘মারণঘাতী সামরিক সরঞ্জাম’ পাঠিয়েছে, যাতে রণাঙ্গনের সামনের কাতারে প্রতিরোধ তৈরি করা যায়। যুক্তরাজ্য স্বল্পমাত্রার ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে ইউক্রেনকে। কিছু ন্যাটো দেশ, যেমন ডেনমার্ক, স্পেন, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস তাদের যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ পূর্ব ইউরোপে পাঠাচ্ছে সেখানকার প্রতিরক্ষাকে জোরালো করতে।

তবে জার্মানি ইউক্রেনের অনুরোধ সত্ত্বেও কোনো অস্ত্রশস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, কারণ দেশটির নীতিই হচ্ছে কোনো সংঘাতপূর্ণ এলাকায় কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র না পাঠানো। পরিবর্তে জার্মানি মেডিক্যাল ত্রাণ সাহায্য পাঠাবে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ অবশ্য উত্তেজনা প্রশমনের জন্য রাশিয়ার সাথে আলোচনা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো কী ব্যবস্থা নিতে পারে?

পশ্চিমা দেশগুলো মূলত মারাত্মক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাই বলছে, যদিও তারা খোলাখুলি স্পষ্ট করে বলছে না এই নিষেধাজ্ঞা ঠিক কেমন হবে।

যে একটি ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে, সেটি হলো একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক বার্তা লেনদেন সার্ভিস ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়াকে বাইরে রাখা। বিশ্বে ২০০’র বেশি দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো এটি ব্যবহার করে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, এটি একটি মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর ফলে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর পক্ষে কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক লেনদেন চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।

২০১২ সালে এটি ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে এরকম নিষেধাজ্ঞায় উল্টো ফলও হতে পারে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মান ব্যাংকগুলোর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে।

যুক্তরাষ্ট্র চাইলে রাশিয়াকে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। এর মানে দাঁড়াবে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য একেবারে সীমিত হয়ে পড়বে। এর বিরাট প্রভাব পড়তে পারে রুশ অর্থনীতিতে। আন্তর্জাতিক ঋণ বাজার থেকে যাতে রাশিয়া ঋণ করতে না পারে, সেরকম নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারে।

নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতে পারে প্রেসিডেন্ট পুতিন ও তার ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে।

পশ্চিম ইউরোপে রাশিয়া যে জ্বালানি বিক্রি করে, সেটি বন্ধ করার কথাও আলোচনায় আসছে। কিন্তু এর কোনো বিকল্প এখন পর্যন্ত জার্মানি বা অন্য দেশগুলোর নেই।

তবে পশ্চিমা দেশগুলোর নিজেদের মধ্যেই আসলে মতবিরোধ রয়েছে যে তারা রাশিয়াকে শাস্তি দিতে কতদূর পর্যন্ত যাবে।

সূত্র : বিবিসি

২:৩১ AM

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Holy Foods ads

Holy Foods ads

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget