হুমায়ুন কবির শাওন। ২৫ বছর বয়সী এ যুবক ভোট দিতে এসেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের শিমরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ভোট দেয়ার জন্য তিনি সকাল ১০টার সময় এসে একটি লাইনে দাঁড়ান। তারপর চলে যায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে বের হওয়ার সময় তার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। ভোট কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করতে অনেকটা রাগান্বিত সুরে বললেন, আড়াই ঘণ্টা ধরে ছোট একটা লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার সামনে ছিলেন ৮০ জনের মতো ভোটার। তাদের ভোট শেষ হতে হতে এতটা সময় লেগে গেছে।
ভেতর থেকে যারাই আসছে সবার মাঝে রাগ রাগ ভাব। কেন এই রাগ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সময় বেশি যাচ্ছে। অনেকের আঙ্গুলের ছাপ মেলেনি। তাদের পেছনে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। আবার কখনো ইভিএম মেশিনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। সবমিলিয়ে জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে আসার অভিজ্ঞতা খুব সুখকর না। একই বিরক্তির কথা জানালেন রুহুল আমিন নামের আরেক মধ্য বয়সী ব্যক্তি। তিনি বলেন, আগেও অনেকবার ভোট দিয়েছি। কিন্তু কখনো এত সময় লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। এবার ইভিএমে ভোট হওয়াতে সময় খুব বেশি যাচ্ছে। তবে এই কেন্দ্রের ভেতরে ভোটারদের মধ্যে বিরক্তি ভাব থাকলেও কেন্দ্রের বাইরে ছিল উত্তাপ। বিভিন্ন প্রার্থীর সমর্থকরা বিভিন্ন প্রতীকের নাম ধরে চিৎকার চেঁচামেচি করছিলেন। কেন্দ্রে আসা ভোটারদের প্রতীকসহ স্লিপ দিয়ে ভোট প্রয়োগের অনুরোধ করছিলেন।
একই ওয়ার্ডের মহিলাকেন্দ্র শিমরাইল দারুচ্ছুন্নাত ছালেহিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল প্রায় একই অবস্থা। ২ হাজার ৪৭২ ভোটের এই কেন্দ্রটি অনেকটা ঘিঞ্জি পরিবেশের। এই কেন্দ্রের মোট ৬টি বুথে ভোটগ্রহণ করা হয়। নারী ভোটারদের চাপে ভোটগ্রহণকারীদের হিমশিম খেতে হয়েছে। তবে ভোটারের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ ছিল চরমে। কারণ ঘিঞ্জি পরিবেশে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে ভোটারদের। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকে ভোট দিতে পারছিলেন না। আঙ্গুলের ছাপ মেলেনি অনেকের আবার ইভিএম মেশিনে সমস্যা থাকায় সময় নষ্ট হয়েছে। কেন্দ্রটির ভেতরে যেমন লম্বা লাইন ছিল ঠিক তেমনি বাহিরেও ছিল লম্বা লাইন। বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারদের নিয়ে রীতিমতো টানাটানি করছিলেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনুসারীরা। প্রার্থীদের প্রতীকসহ স্লিপ নিয়ে ভোট কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করানোর চেষ্টা করছিলেন সমর্থকরা। প্রার্থীর সমর্থকদের টানাটানিতে অনেক ভোটার বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন।
প্রিজাইডিং অফিসার মাসুদ মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, আমাদের বয়স্ক ভোটাররা ইভিএমে অভ্যস্ত না। এজন্য ভোট দিতে সময় লাগছে। যদি অভ্যস্ত হয়ে যায় তবে আর এমন সমস্যা হবে না। আমরা ইভিএম মেশিন নিয়ে খুবই সতর্ক ছিলাম। আগের রাতেও মেশিন চালু করে দেখেছি ঠিক আছে কিনা। ভোটের দিন সকাল ৬টায় চালু করেছি। এ ছাড়া টেকনিশিয়ানরাও সার্বক্ষণিক প্রস্তুত ছিল।
চার নম্বর ওয়ার্ডের সিদ্ধিরগঞ্জ উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রার্থীর সমর্থকদের আনাগোনায় পা ফেলার জায়গা ছিল না। ভোটাররা ভোট দিতে আসলেই সব প্রার্থীদের সমর্থকরা ভোটারদের আলাদা আলাদা ঘিরে ধরছেন। সব সমর্থকই তাদের প্রার্থীদের স্লিপ ভোটারদের নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। কেন্দ্রের বাহিরের পুরো সড়কে ছিল সমর্থকদের দাপট। কেন্দ্রে প্রবেশের সময় স্কুলের গেটে আবার ভোটারদের ধরে ধরে অনুরোধ করা হয়। বাহিরের উত্তাপ পেরিয়ে ভেতরে যাওয়ার পর ভোটাররা নতুন সমস্যায় পড়েন। কারণ এই কেন্দ্রটি ঝুঁকিপূর্ণ ও ঘিঞ্জি পরিবেশের। কেন্দ্রটিতে মোট ভোটার ৩ হাজার ৪৫৭টি। সেই তুলনায় ভোটাররা লাইন ধরে দাঁড়ানোর মতো স্থান পাচ্ছিলেন না। কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট কক্ষ পর্যন্ত যাওয়ার পর ভোটারদের বলা হয় ওই কক্ষে তাদের ভোট হবে না। যেতে হবে অন্য কক্ষে। সেখানে যাওয়ার পর আবার ভোটারদের পাঠানো হচ্ছে দ্বিতীয়তলায়। এভাবে এই কেন্দ্রে ভোটাররা হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
ভোটাররা বলেন, এই কেন্দ্রে সিরিয়াল মেইনটেইন নিয়ে সমস্যা ছিল। আনসাররা ভুল লাইনে দাঁড় করিয়ে তাদেরকে এমন ভোগান্তিতে ফেলেছে। এ ছাড়া ইভিএম মেশিনে একজন ভোটারের পেছনে সময় নষ্ট হয়েছে ১৫ থেকে ২০ মিনিট করে। এসব সমস্যার কারণে ১১০ বছর বয়সী এক নারী নিজের ভোট দিতে পারেননি। রুহান নামের এক ভোটার বলেন, সকাল ৮টায় ভোট দিতে এসেছি। আনসারদের কথামতো লাইনে দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে একটি কক্ষে যাওয়ার পর দোতলায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে আবার নিচে পাঠানো হয়। এভাবে প্রায় দুই ঘণ্টায় ভোট দিয়েছি। রেহেনা বেগম নামের ভোটার বলেন, সকালে এসেছি। সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ভোট দিতে পারি নাই। এক লাইন থেকে আরেক লাইন। এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে যেতে এত সময় গেল। করোনার মধ্য মানুষের ঠাসাঠাসিতে অস্বস্তি লাগছে।
সরজমিন এই কেন্দ্রে দেখা যায়, কেন্দ্রটিতে ভোটারের চাপে পা ফেলার অবস্থা নাই। পুরুষ ও নারী ভোটাররা গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভেতরে ভোটগ্রহণ বিলম্বিত হওয়াতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভোটাররা। স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না কেউ। অনেকের মুখে মাস্ক ছিল না। প্রিজাইডিং অফিসার নুরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, কেন্দ্রে ভোটার বেশি। ৩ হাজার ৪৫৭ ভোটের মধ্য পুরুষ ১ হাজার ৬৬৫ জন আর মহিলা ১ হাজার ৭৯২ জন। পুরুষের তুলনায় মহিলা বেশি। মোট ৯টি কক্ষে ভোটগ্রহণ নেয়া হয়। মেশিনে সমস্যা ছিল কিন্তু সমাধান করা হয়েছে। এতে করে ভোটগ্রহণে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন