পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) তিনটি নির্বাচনেই ঘুরেফিরে দুটি নাম আলোচনার পুরোভাগে চলে আসছে। তারা হচ্ছেন- নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের এমপি এ কে এম শামীম ওসমান এবং মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী।
নাসিকের প্রথম নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থী আইভীর কাছে পরাজিত হন শামীম ওসমান। দ্বিতীয় নির্বাচনে আইভী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও নির্বাচনের শুরুর দিকে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শামীম ওসমান আলোচনার শিরোনাম হয়েছিলেন। এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। কিন্তু অবস্থান নড়চড় হয়নি শামীম ওসমানের। তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ঘরানার রাজনীতিতে এরই মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
আইভীর নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেছেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতারা শামীম ওসমানকে ঢাকায় দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের অনুরোধ করেও ইতিবাচক সাড়া পাননি। এমনকি বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জে দলের বিজয় সমাবেশে তার অনুপস্থিতি ছিল চোখের পড়ার মতো। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে- কী চান শামীম ওসমান?
আরো পরুনঃ- নেতাকর্মীরা সবাই আমার সঙ্গে আছেন: আইভি
এই প্রশ্ন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদেরও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন নেতা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নাসিক নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণার আগে জাতীয় সংসদে এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আইভীকে মনোনয়ন দেওয়ার ইঙ্গিত করে এ বিষয়ে শামীম ওসমানকে সহযোগিতার কথা বলেছিলেন। কিন্তু শামীম ওসমানের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত আইভীকে নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়ে সহায়তা দেওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে নেতারা জানিয়েছেন।
আইভীর নির্বাচনী কর্মকাণ্ড দেখভালের জন্য গঠিত কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সদস্য সচিব মির্জা আজম। এ দুই নেতার একজন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। আরেকজন সাংগঠনিক সম্পাদক। তারা দফায় দফায় টেলিফোনে কথা বলেছেন শামীম ওসমানের সঙ্গে। কিন্তু তাতেও এখন পর্যন্ত ইতিবাচক কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নীতিনির্ধারক নেতা জানিয়েছেন। ফলে এ নিয়ে দলের ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অনেকেই শামীম ওসমানকে নিয়ে রীতিমতো অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এসব বিষয়ে জানতে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামীম ওসমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সমকালকে বলেছেন, এ মুহূর্তে খোলামেলা কিছুই বলতে পারছি না। সময় হলেই কথা বলব। এ জন্য তিনি অপেক্ষা করার অনুরোধ করেছেন। তার দাবি, তিনি দলের কোনো নেতাকর্মীকে বাধা দেননি। তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার জন্য দলের সব স্তরের নেতাকর্মীকে নির্দেশও দিয়েছেন। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে আসা মহিলা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাদের স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের আপ্যায়ন করেছেন। তাদের উৎসাহ দিয়েছেন।
কিন্তু ওসমানের এ বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের। তারা যে কোনো প্রক্রিয়ায় আইভীর নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে শামীম ওসমানের ইতিবাচক অবস্থান দেখতে চাইছেন। তবে এমপি হওয়ায় নির্বাচনী প্রচারণায় সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ নেই শামীম ওসমানের। এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার আইভী এক নির্বাচনী অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'শামীম ওসমানকে খুব কি জরুরি আজকে আমাদের এই নির্বাচনে? তিনি তো ইচ্ছে করলেও প্রচারে আসতে পারবেন না। তাই আসুন, আমরা নির্বাচনের মধ্যেই থাকি।'
অবশ্য আইভীর এ বক্তব্যেরও সমালোচনা করেছেন দলের নেতাকর্মীদের অনেকে। তাদের দৃষ্টিতে, নির্বাচনী বৈতরণী পেরোতে হলে সম্মিলিত চেষ্টায় এগোতে হবে। ইচ্ছা করে নিজের দলের কাউকে এড়িয়ে চললে নিজেরই শক্তি ক্ষয় হবে। তাই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে দলের প্রার্থীকে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আইভীর খুব একটা আগ্রহ নেই বলে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন। তাদের ভাষায়, আইভী নানাভাবে আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছেন- তার নির্বাচনে শামীম ওসমানের ভূমিকার খুব একটা দরকার নেই। কিন্তু কর্মীরা তা মনে করছেন না। অবশ্য তারা এখনও নিস্ক্রিয় থাকায় শামীম ওসমানকে দুষছেন।
কিন্তু নানা অবস্থান থেকে, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের চেষ্টার পরও শামীম ওসমানকে সক্রিয় করা সম্ভব হচ্ছে না। শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতা ক্ষুব্ধ ভাষায় বলেছেন, প্রতিটি নাসিক নির্বাচনেই একগুঁয়েমি করেছেন শামীম ওসমান। বিশেষ করে তার এবারকার ভূমিকায় নেতাকর্মীদের অনেকেই তার ওপর খুব ত্যক্ত-বিরক্ত। শামীম ওসমান আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ একজন নেতা। তবে এটাও ভুলে গেলে চলবে না, তিনি প্রয়াত নেতা আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বাকশালের জাতীয় ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছিলেন। তার তিন ভাই এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগ তাকে কী দেয়নি! অথচ নাসিক নির্বাচন এলেই তিনি নানা বাহানা ধরেন। আর তখন খুব লজ্জা পায় আওয়ামী লীগ।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর সন্দেহ, নাসিক নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকারের সঙ্গে শামীম ওসমান ঘরানার নেতাকর্মীদের কৌশলী যোগাযোগ রয়েছে। তারা এ ব্যাপারে খোঁজখবরও রাখছেন। তবে শামীম ওসমান এমন ধরনের অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও অনেক নেতাকর্মীর দুশ্চিন্তা কাটছে না। এ অভিযোগ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছেও রয়েছে।
আরো পরুনঃ- তৈমুরকে প্রত্যাহার বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল: আইভী
শামীম ওসমান ও আইভীর মধ্যকার দূরত্ব দীর্ঘদিনের পুরোনো। এ দুই নেতার শীতল সম্পর্কের কারণে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ ঘরানার রাজনীতিতেও বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। স্থানীয় নেতাকর্মীরা স্পষ্ট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আছেন। এ নিয়ে দুই পক্ষ সরাসরি দ্বন্দ্ব-বিবাদে জড়িয়ে রয়েছে। এসব কারণে প্রায় সময়ই নেতিবাচক খবরের শিরোনাম তৈরি হচ্ছে।
২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শামীম ওসমান ও ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর মধ্যকার মতবিরোধের বিষয়টি প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আসে। শামীম ওসমান ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেলেও জয় পান নাগরিক পরিষদের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। নির্বাচনের আগের দিন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। সেই থেকে আওয়ামী লীগের দুই নেতা সুযোগ পেলেই পরস্পরের বিরুদ্ধে কথা বলে আলোচনায় এসেছেন।
ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলে আলোচিত দুই নেতার বাগ্যুদ্ধ দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। স্থানীয় নেতাকর্মীরা তিক্ততায় জড়িয়ে পড়েন। ওই নির্বাচনে এ কে এম শামীম ওসমান দলীয় মনোনয়ন চাননি। তিনি নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের দলীয় প্রার্থিতার পক্ষে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই অবস্থায় শামীম ওসমান ও আইভীকে ডেকে নিয়ে গৃহদাহ মিটিয়ে দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারও দুই নেতার বিরোধ মিটিয়ে দেবেন বলে নেতাকর্মীরা আশায় রয়েছেন। অন্যদিকে, দলীয় প্রার্থীর পক্ষে শামীম ওসমানকে সক্রিয় করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক সমকালকে জানিয়েছেন, চেষ্টা চলছে। মির্জা আজম বলেছেন, তিনি প্রায় প্রতিদিনই শামীম ওসমানের সঙ্গে কথা বলছেন। শামীম ওসমানও দুই নেতার যোগাযোগের কথা অবলীলায় স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, খুব দ্রুতই তিনি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন