বিবিসি ওয়ার্ল্ড টেলিভিশন যখন সন্ধ্যা ৭টার খবর শুরু করল ইউক্রেইনের রাজধানী কিয়েভের এক টিভি টাওয়ারে রাশিয়ার হামলায় হতাহতের খবর দিয়ে, রাশিয়ার টিভিগুলো তখন ইউক্রেইনের বিভিন্ন শহরে হামলার জন্য তাদেরই দায়ী করে খবর প্রচার করছে।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো যখন ইউক্রেইনে যুদ্ধের ময়দান থেকে পাওয়া ছবি ও তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ উপস্থাপন করছে, তার ঠিক বিপরীত একটি বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে রাশিয়ার টেলিভিশনে।
দুই পক্ষের এই বিপরীত চিত্র তুলে ধরে বিবিসি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, রুশ টেলিভিশন চ্যানেলগুলো একটি বিকল্প বাস্তবতা তৈরি করছে সেদেশের দর্শকদের জন্য।
রাশিয়ার টিভি দর্শকরা তাহলে যুদ্ধকে কীভাবে দেখছে? তারা আসলে কী বার্তা পাচ্ছে?
ক্রেমলিন এবং এর করপোরেট মিত্রদের নিয়ন্ত্রিত গুরুত্বপূর্ণ টেলিভিশন স্টেশনগুলোর প্রচারিত ১ মার্চের খবর থেকে টুকরো টুকরো দৃশ্য নিয়ে একটি চিত্র তৈরির চেষ্টা করেছে বিবিসি।
রাশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন স্টেশন চ্যানেল ওয়ানের সকালের বুলেটিনে খবর, বিনোদন, খেলা- সবকিছুই থাকে। তবে মস্কো সময় মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টায় তাদের স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম হল।
সংবাদ উপস্থাপক পর্দায় উপস্থিত হয়ে বললেন ‘সবার জানা ঘটনাপ্রবাহের কারণে’ তাদের সূচিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন থেকে আরও বেশি বেশি খবর এবং সাম্প্রতিক বিষয়াবলী থাকবে দর্শকদের জন্য।
চ্যানেল ওয়ানের সংবাদে দাবি করা হয়, ইউক্রেইনের সেনাবাহিনীর হাতে রুশ সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংসের যেসব খবর প্রচার করা হচ্ছে সেসব ‘মিথ্যা’। ‘অনভিজ্ঞ দর্শকদের বিভ্রান্ত’ করার জন্য ওই অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
টেলিভিশনের পর্দায় ছবি দেখিয়ে সংবাদ উপস্থাপক ব্যাখ্যা করেন, ইন্টারনেটে ‘ভুয়া ছবি’ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। খবরে দাবি করা হয়, ‘নবিশ হাতে ছবি বিকৃত করে’ দেখানো হচ্ছে ইন্টারনেটে।
একই দিন মস্কো সময় সকাল ৮টায় গ্যাজপ্রমের মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির বুলেটিনে শুধু দনবাসের ঘটনাবলীর ওপর খবর প্রচার করা হয়।
সেখানে কিয়েভ অভিমুখে রাশিয়ার ৭০ মাইল দীর্ঘ সামরিক বহরের কোনো উল্লেখ ছিল না। অথচ বিবিসি রেডিও ফোরে আধাঘণ্টা পরের বুলেটিনেই কিয়েভের উত্তরে ওই সামরিক বহরের খবর প্রচার করা হয়।
এনটিভির সংবাদ উপস্থাপক বলেন, “আমরা দনবাস থেকে সর্বশেষ খবর জানাচ্ছি। এলএনআর [লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিক] যোদ্ধারা তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে এবং তিন কিলোমিটার অগ্রসর হয়েছে। অন্যদিকে ডিএনআর [দনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিক] বাহিনী ১৬ কিলোমিটার অগ্রগতি অর্জন করেছে।”
রোশিয়া ১ ও চ্যানেল ওয়ানে - রাশিয়ার দুটি অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল এবং দুটোই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। দুই টিভির খবরেই দনবাস এলাকায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ করা হয়েছে ইউক্রেইনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে।
রোশিয়া ১ এর সংবাদ উপস্থাপক বলেন, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হুমকি রুশ বাহিনীর পক্ষ থেকে নয় বরং ‘ইউক্রেইনীয় জাতীয়তাবাদীদের’ পক্ষ থেকে আসছে।
“তারা দনবাস এলাকায় শিশু ও বেসামরিক লোকজনকে মানববর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে, ইচ্ছাকৃতভাবে আবাসিক এলাকা ঘিরে তাদের সমর প্রস্তুতি নিয়েছে। দনবাসের শহরগুলোর ওপর বোমাবর্ষণ বাড়িয়েছে।”
চ্যানেল ওয়ানের সংবাদ উপস্থাপক বলেন, ইউক্রেনীয় সেনারা ‘আবাসিক ভবনে গোলা বর্ষণের প্রস্তুতি নিচ্ছে’ এবং অ্যামোনিয়ার গুদামে বোমা বর্ষণ করেছে, তাদের লক্ষ্য বেসামরিক নাগরিক ও রুশ বাহিনীকে উসকে দেওয়া।
ইউক্রেইনের পরিস্থিতিকে এসব টেলিভিশনের খবরে ‘যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে না। বরং এই অভিযানকে ইউক্রেইনের বেসামরিকীকরণের উদ্যোগ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। রুশ টিভিগুলো দাবি করছে, রাশিয়ার অভিযানে শুধু ইউক্রেইনের সামরিক স্থাপনাকেই নিশানা করা হচ্ছে।
রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সংবাদ উপস্থাপক ও সাংবাদিকরা ইউক্রেইনে রাশিয়ার এই সামরিক অভিযানকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর বিপক্ষে সোভিয়েত সেনাদের লড়াইয়ের সঙ্গে তুলনা করছেন।
রোশিয়া ১ এর সহযোগী আরেক টেলিভিশন রোশিয়া ২৪ এর সংবাদ উপস্থাপক বলেন, “জাতীয়বাদীরা শিশুদের মানববর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই এটা তাদের কৌশল।”
ইউক্রেনের ক্ষমতাসীনদের ‘ফ্যাসিস্ট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে এসব টেলিভিশনের খবরে।
রাশিয়ার বেশিরভাগ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টিভি স্টেশনের মঙ্গলবার সকালের খবরে সেদেশের সেনাবাহিনীর ইউক্রেনে আক্রমণের বিষয়টি চেপে রাখা হয়। কিয়েভ বা খারকিভের মতো শহর থেকে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে কোনো সংবাদ এসব চ্যানেলে প্রচার করা হয়নি। বরং তারা শুধু দনবাস এলাকায় থেকে সেখানকার খবরই তুলে ধরেছে।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত বিকেলের সংবাদ বুলেটিনে এনটিভি খারকিভে বোমা বর্ষণের সংবাদ প্রচার করে। কিন্তু এই বোমাবর্ষণে রুশ বাহিনীর জড়িত থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে এ ধরনের খরবকে ‘ভুয়া’ হিসেবে প্রচার করে।
রোশিয়া ১ চ্যানেলে বলা হয়, “ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার দিক বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হচ্ছে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে সেটি ছোড়া হয়েছে, যেখানে কোন রুশ সেনার উপস্থিতি নেই।”
হামলার জন্য প্রকারান্তরে ইউক্রেইনের বাহিনীকেই দায়ী করে তারা।
বিবিসি লিখেছে, রুশ টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে সেদেশের গণমাধ্যম পর্যবেক্ষক সংস্থা রসকমনাদজরের সরকারি ভাষ্যই অনুসরণ করতে হচ্ছে।
তবে সরকারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেও অনেক সংবাদ পাঠক, আলোচক একইসুরে কথা বলছেন না। দুয়েকজন এখনও ইউক্রেইনের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে চলেছেন।
আর এর জেরে চরমপন্থা ও সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে টেলিভিশন চ্যানেল দজএইচডি এবং জনপ্রিয় বেতার এখো মোস্কভির ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আরো পড়ুন:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন