বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই পথে পথে লাশ

 বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই পথে পথে লাশ


There is no electricity, no water


ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ১১ দিনের মাথায় দেশটিতে যুদ্ধের দুর্যোগের অভিঘাত তীব্র হতে শুরু করেছে। গুলি-গোলা ও বোমার পাশাপাশি যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠেছে। পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই; পথে পথে পড়ে আছে লাশ। মরদেহ সরিয়ে নেওয়ার মানুষও যেন নেই। মারিউপোল, খারকিভ, খেরসন, ইরপিনসহ বেশ কিছু শহরে চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিচ্ছিন্ন পথঘাটও মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।


সর্বাত্মক হামলায় না গিয়ে স্থল অভিযানের মাধ্যমে রাশিয়া ধীরে ধীরে ইউক্রেনের শহর-নগর ঘিরে ফেলছে। এতে করে গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন হচ্ছে ইউক্রেনীয়রা। খাবার সংকট ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। বেশকিছু হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে রুশ বাহিনী। যুদ্ধাহত মানুষের চিকিৎসা ও ওষুধের সংকট ভয়ানক রূপ নিচ্ছে।


মারিউপোল চার লাখ মানুষের শহর। গতকাল সেখানে দ্বিতীয়বারের মতো কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার ঘোষণা দেয় মস্কো-কিয়েভ। তবে কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই কিয়েভ অভিযোগ করে, এবারও যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী। তবে আগের দিনের মতো মস্কো দাবি করেছে, বাসিন্দাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য আটকে রেখে তারাই আবার যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের অভিযোগ করছে।


এর আগে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, রুশ বাহিনীর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে নিতে মারিউপোলে একটি নতুন রুট ঠিক করা হয়েছিল।


স্থানীয় সময় গতকাল দুপুর থেকে এটি কার্যকর হয়। মারিউপোলে মানবিক সহায়তার দায়িত্বে থাকা আন্তর্জাতিক রেড ক্রস জানিয়েছে, ঠিক কত সময়ের জন্য, কোন পথে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা হবে- তা নিয়ে দু'পক্ষ একমত হতে পারছে না। ফলে তা ব্যর্থ হচ্ছে। কিছু মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার পর দ্বিতীয় দিনের মতো কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে তারা।


ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দাবি করেছেন, 'রুশ বাহিনী এখন বন্দর শহর ওডেসায় গোলাবর্ষণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।' বন্দরটি রুশ দখলে চলে গেলে সমুদ্রপথ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে কিয়েভ। তখন দুর্যোগের সীমা থাকবে না। এর কয়েক ঘণ্টা পর এক ভিডিওবার্তায় জেলেনস্কি দাবি করেন, কিয়েভের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভিনিৎসিয়া বিমানবন্দর গুঁড়িয়ে দিয়েছে রুশ সেনারা। এ অবস্থায় ইউক্রেনের আকাশে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণার জন্য পশ্চিমা নেতাদের প্রতি ফের অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।


রাজধানী কিয়েভ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট শহর ইরপিনে শুধু বিস্ম্ফোরণের শব্দ। রাশিয়ার যে বিশাল সামরিক বহর কিয়েভের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, সেটির সামনের অংশ এই শহরের কাছে অবস্থান করছে। শহরটির ওপর ব্যাপক গোলাবর্ষণ হচ্ছে, বিমান হামলা চলছে। এর মধ্যেই প্রাণ বাঁচাতে শিশু-বৃদ্ধদের নিয়ে সেখানকার বাসিন্দারা ঘর ছেড়েছেন। বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত একটি ব্রিজের নিচে গতকাল জটলা পাকানো মানুষ দেখা গেছে। পাশেই একটি রাস্তার ওপর পড়ে আছে দু'জনের লাশ। বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, গত শনিবার পালানোর সময় গুলিতে নিহত হন তারা। সেই থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত সেখানেই পড়ে ছিল মরদেহ দুটি।


ইরপিনে ভবনের বেজমেন্ট, আন্ডারগ্রাউন্ড ও বাঙ্কারে অবরুদ্ধ থাকা মানুষ এখন ভয়ে পালানোর চেষ্টা করছে। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, পালানোর সময় এক পরিবারের চারজন গুলি অথবা গোলায় নিহত হয়েছে। বাড়ির সামনে তাদের নিথর দেহ পড়ে আছে। লাশের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, তা প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি। ইরপিনের বাসিন্দা বিবিসির ইউক্রেনের সাংবাদিক ভিক্টোরিয়া প্রিসেদস্কায়ার ৭৩ বছর বয়সী বাবা বলেছেন, 'ঘর থেকে উদ্ধারকারী গাড়ির দিকে যাওয়ার মুহূর্তেও আমাদের ওপর গোলা ছোড়া হয়েছে।'


ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভ ও সামি শহরেও গতকাল মুহুর্মুহু বোমা হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। মারিউপোলের মতো সামিও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। সেখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দা ঘরবন্দি।


ভারতের এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, ওডেসাসহ বিভিন্ন শহরে আটকে পড়া ভারতীয় শিক্ষার্থীরা প্রতিটি মুহূর্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পার করছেন। খাবার পানির অভাবে রাস্তায় জমে থাকা বরফখণ্ড কুড়িয়ে তা গলিয়ে তেষ্টা মেটাচ্ছেন তারা।


নিহত ও শরণার্থী: জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা গতকাল জানিয়েছে, যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে ইউক্রেন ছেড়ে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, মলদোভা, রোমানিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বেশি শরণার্থী দেখল ইউরোপ। এ ছাড়া শনিবার পর্যন্ত বেসামরিক মানুষ নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬৮। সব মিলে নিহতের সংখ্যা এক হাজার ১০০ ছাড়িয়েছে।


প্রবাসে ইউক্রেন সরকার গঠনের উদ্যোগ: প্রবাসে ইউক্রেন সরকার গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন পশ্চিমা নেতারা। রুশ বাহিনী দেশটির অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নিলেও যাতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যায়, সে জন্য এ উদ্যোগ। যুক্তরাষ্ট্রসহ এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা করা কয়েকটি দেশের কর্মকর্তাদের সূত্রের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট।


যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে পারে: যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সুরে তার ডেপুটি ডোমিনিক রাব গতকাল বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বহু বছর ধরে না হলেও বহু মাস ধরে চলতে পারে। এর আগে জনসনও একই রকমের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন। গতকাল পুতিনকে থামানোর কৌশল হিসেবে পশ্চিমা নেতারা ছয়টি প্রস্তাব দিয়েছেন। তাতে কূটনৈতিকভাবে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে যুদ্ধের অবসানে কোনো নির্দেশনা নেই। ফলে এই যুদ্ধ যে দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে, এ থেকে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

বাইডেন, বেনেট ও মাস্কের সঙ্গে জেলেনস্কির বৈঠক: ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি গত ২৪ ঘণ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট ও বহুজাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টেসলার প্রধান ইলন মাস্কের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। তারা সবাই তাকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। এদিকে ইউক্রেনকে এক হাজার কোটি ডলার সহায়তা দেওয়ার একটি প্রস্তাব মার্কিন কংগ্রেসে পাঠিয়েছেন বাইডেন।


পুতিন-মাখোঁ বৈঠক: ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে দুই ঘণ্টা ফোনে কথা বলেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন। মাখোঁকে তিনি বলেছেন, যুদ্ধ বা সমঝোতা- যে উপায়েই হোক, রাশিয়া তার লক্ষ্যে পৌঁছাবে। এ সময় জারোপিঝিয়া পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে পুতিন বলেন, পরমাণু সন্ত্রাসের ধুয়া তুলে বিশ্বকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে উস্কাতে চাইছেন জেলেনস্কি।


তৃতীয় দফার বৈঠক: রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে আজ বেলারুশে তৃতীয় দফায় বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় দফার আলোচনার অগ্রগতির ভিত্তিতে এই দফায় বরফ আরেকটু গলতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। সূত্র :বিবিসি, আলজাজিরা, সিএনএন ও স্পুটনিক নিউজ।


আরো পড়ুন:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Holy Foods ads

Holy Foods ads

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget