রাশিদ রিয়াজ : এবার বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দিতে একটি পোস্টার প্রকাশ করেছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট। তাতে বলা হয়েছে, ‘বাংলা ও হিন্দি খিলাফার সৈনিকদের চুপ করিয়ে দিয়েছেন বলে যদি আপনারা মনে করেন তাহলে শুনুন, আমাদের কখনও চুপ করিয়ে দেওয়া যায় না। বদলা নেওয়ার তৃষ্ণা কখনও মোছার নয়।’ এধরনের বার্তা দিয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি এ বার ভারত ও বাংলাদেশে হামলার সরাসরি হুমকি দিল।
‘বাংলা’য় হামলার জন্য নয়া দায়িত্বপ্রাপ্ত আবু মুহম্মদ আল-বেঙ্গলি নামে একজনের নামও ঘোষণা করেছে এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। ঢাকায় একটি সিনেমা হলের কাছে একটি ছোট বিস্ফোরণ ঘটানোর পরদিনই এই হুমকি দিল আইএস। সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে ছোট একটি বিস্ফোরণ হয়। খুব বড় কোনও ক্ষয়ক্ষতি না-হলেও কয়েকজন পুলিশকর্মী তাতে আহত হন।
মঙ্গলবার ভোরে তাদের মুখপত্র অমাকে বিবৃতি দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশকে হুমকি দিয়েছে এই সংগঠন। বাগদাদির ভাষণ-সহ এই হুমকি বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে। দিনকয়েক আগেই আরও একটি বাংলায় পোস্টারে এমনই ইঙ্গিত মিলেছিল। ইসলামিক স্টেটকে সমর্থনকারী একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া একটি পোস্টার বাংলা হরফে লেখা হয়, ‘শীঘ্রই আসছি, ইনশাল্লাহ…’। টাইমস অব ইন্ডিয়া
তবে বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আইএসএর এধরনের হুমকি গত কয়েক বছর ধরে দিয়ে আসা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলে ২০১৬ সালের ১৫ এপ্রিল ‘বাংলাদেশে আইএস-র নতুন ফ্রন্ট! নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এধরনের আশঙ্কা নাকচ করে দিয়েছিলেন। এধরনের হামলার আশঙ্কা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিবেদনটি পাঠক সমীপে পুনরায় দেয়া হল:
বাংলাদেশে আইএস-এর নতুন ফ্রন্ট!
তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর মুখপত্র বলে পরিচিত ‘দাবিক’ ম্যাগাজিনে বাংলাদেশে আইএস-এর নতুন ফ্রন্ট খোলার কথা বলা হয়েছে৷ তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বাংলাদেশে আইএস-এর অস্তিত্ব নেই৷
ভারত ও মিয়ানমারে আক্রমণ চালাতে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলেও দাবিকের সর্বশেষ সংখ্যায় বলা হয়৷ এছাড়া দাবিক বলছে, বাংলাদেশে আইএস পরিচালনার দায়িত্বে আছেন আবু ইব্রাহিম৷ আবু জান্দাল নামে এক বাংলাদেশি আইএস সদস্য সিরিয়ায় যুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলেও জানিয়েছে ম্যাগাজিনটি৷
বাংলাদেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, বিদেশি নাগরিক আর ব্লগার খুনের ধারাবাহিকতায় দাবিক দাবি করছে, ‘‘বাংলাদেশের স্থানীয় জিহাদিরা আইএসের প্রতি আনুগত্য জানিয়েছে এবং তাদেরকে আইএসের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷”
‘আইএস বাংলাদেশ ও ভারতে বিস্তৃত হতে চায় এমন তথ্য আমাদের হাতে নেই’
দাবিক এর সর্বশেষ সংখ্যার শেষ কয়েক পাতায় শেখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নামের এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে৷ আবু ইব্রাহিম এখন বাংলাদেশে আইএস-এর তৎপরতা পরিচালনা করছেন৷ সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার সরকারকে ভারতের প্রতি অনুগত উল্লেখ করে আবু ইব্রাহিম বলেন, ‘‘এই অঞ্চলের মুসলমানরা বিশেষত বার্মার মুসলমানরা বৌদ্ধ ধর্ম ও হিন্দুত্ববাদের ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার৷”
তিনি জানান, আইএস বাংলাদেশে জিহাদি কার্যক্রম শক্তিশালী করার পর তাঁরা মিয়ানমারে তৎপরতা শুরু করবেন৷ আবু ইব্রাহিম বলেন, ‘‘বাংলাদেশে হিন্দুদের ব্যাপক পরিমাণে টার্গেট করা না গেলে সেখানে শরিয়া প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়৷”
হত্যা, আতঙ্ক আর ঘৃণায় আইএস
তাদের কাছে নারী যেন বাজারের পণ্য
অনেক সময় আটক নারী ও শিশুদের আইএস জঙ্গিরা যৌন দাস হিসেবে ব্যবহার করে৷ সম্প্রতি আইএস-এর কবল থেকে পালিয়ে আসা ৪০ জনেরও বেশি ইয়াজিদি নারীর সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ নারী ও শিশুদের সঙ্গে আইএস-এর এমন আচরণে নিন্দা জানিয়েছেন সবাই৷
দাবিক-এ আবু জান্দাল আল বাঙালি নামের এক ব্যক্তির প্রোফাইল প্রকাশ করা হয়৷ তাতে বলা হয়েছে, ‘‘জান্দাল সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে আইন ইশার যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন৷ জান্দাল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার এক সমৃদ্ধ পরিবারের সন্তান, তার সামরিক সংশ্লিষ্টতা ছিল৷ তিনি আইএসের প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেওয়ার পর থেকেই শহীদী মৃত্যুকে বরণ করতে প্রস্তুত ছিলেন৷ জান্দাল একজন একনিষ্ঠ জিহাদি ছিলেন এবং বাংলাদেশে জিহাদের পক্ষে একনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি৷”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য
তবে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শুক্রবার বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে আইএস-এর কোনও অস্তিত্ব নেই৷ বাংলাদেশে আইএস-এর কোনও সাংগঠনিক ভিত্তি নেই৷ তবে তাদের অনুসারী কেউ থাকতে পারেন৷ এদেশে আইএস-এর কোনও আস্তানা হবেও না৷”
আইএস এর সঙ্গে বাংলাদেশকে জড়িয়ে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র বলেও মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷
কোথা থেকে অর্থ পাচ্ছে আইএস?
বেআইনি তেল বিক্রি
বেআইনি ভাবে পেট্রোলিয়াম বিক্রি আইএস-এর আয়ের প্রধান উৎস৷ সিরিয়া ও ইরাকে বেশ কিছু বড় তৈলকূপ আপাতত তাদের দখলে৷ মূলত তুরস্কের মধ্য দিয়েই তারা চোরাচালানের কাজ চালিয়ে থাকে৷ মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, কালোবাজারে তেল বিক্রি করে আইএস-এর মাসে প্রায় ৪ কোটি ডলার আয় হয়৷
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইএস-এর অস্তিত্ব অস্বীকার কললেও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু নতুন আরেকটি তথ্য দিয়েছেন৷ তিনি বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘নিহত আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের কাছে প্রশিক্ষণ নেয়া অন্তত ৮ হাজার জঙ্গি বাংলাদেশে রয়েছে৷ তাদের তৎপরতার কারণে বাংলাদেশ ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিতে রয়েছে৷”
বিশেষজ্ঞ মত
এদিকে, বাংলাদেশে আইএস-এর নতুন ফ্রন্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ (অব.) ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আইএস এখন তাদের মূল ভূখন্ডে বিপদে আছে৷ তাই তারা বিস্তৃত হতে চায়৷ তবে তারা বিস্তৃত হতে চায় পশ্চিমে, পশ্চিম ইউরোপে৷ দক্ষিণে বা বাংলাদেশ ও ভারতে তারা বিস্তৃত হতে চায় এমন কোনও প্রমাণ বা তথ্য এখনো আমাদের হাতে নেই৷ পশ্চিমে বিস্তৃত হলেই তাদের টার্গেটের জন্য সুবিধা৷”
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে যেসব জঙ্গি গ্রুপ আছে তারা দেশজ৷ তাদের কিছু রাজনৈতিক দল আশ্রয়, প্রশ্রয় দেয়৷ তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী অন্যতম৷ বাংলাদেশি জঙ্গিদের যা কিছু আন্তর্জাতিক যোগাযোগ তা জামায়াতে ইসলামীর মাধ্যমেই৷”
আল কায়েদা থেকে তৈরি হওয়া সুন্নি মুসলমানদের জঙ্গি সংগঠন আইএস৷ সাদ্দাম পরবর্তী সময়ে ইরাকে এবং বাশার আল আসাদের আমলে সিরিয়ায় সুন্নিদের হতাশা থেকেই জন্ম সংগঠনটির৷ আইএস-এর পতাকায় লেখা থাকে, ‘মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর নবী’ এবং ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই৷’
(amadershomoy)