ক্রাইস্টচার্চে হামলার এক সপ্তাহ পূর্ণ হলো গতকাল শুক্রবার। এই সাত দিনে নিউজিল্যান্ড থেকে শোকের ছায়া হয়তো পুরোপুরি মুছে যায়নি, কিন্তু মানুষে মানুষে বন্ধনটা সেখানে আরো সুদৃঢ় হয়েছে। যে বর্ণবিদ্বেষ ছড়ানোর লক্ষ্যে হামলাটি হয়েছিল, গত এক সপ্তাহে সেই বিদ্বেষ উল্টো বিলীন হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ ভুলে সেখানকার মানুষ নিজেদের ক্রমাগত আবিষ্কার করছে শুধুই মানুষ হিসেবে।
এদিকে হামলায় নিহত পাঁচ বাংলাদেশির জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুজনের দাফনও হয়েছে সেখানে। বাকি তিনজনের লাশ দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
গত শুক্রবার উগ্র বর্ণবিদ্বেষী ব্রেন্টন টারান্টের বন্দুকের গুলিতে রক্তাক্ত হওয়া আল-নুর মসজিদ এখনো মুসল্লিদের জন্য উন্মুক্ত হয়নি। তাই গতকাল জুমার নামাজ হয় ওই মসজিদের পাশে; হ্যাগলি পার্কের খোলা মাঠে। তবে এবারের দৃশ্য ছিল অন্যান্য শুক্রবারের চেয়ে আলাদা। শুধু মুসলমান নয়; গতকাল সেখানে মুসল্লিদের প্রতীকী সুরক্ষা হিসেবে জড়ো হয়েছিল নিউজিল্যান্ডের নানা ধর্মের, নানা বয়সের, নানা বর্ণের মানুষ। বাদ ছিলেন না খোদ প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নও। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় আজান। দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয় নিহতদের স্মরণে।
জুমার নামাজের পর স্থানীয় মাউরি জনগোষ্ঠীর তিন সদস্যের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেন আহমেদ খান নামের এক ব্যক্তি। তিনি বহু পথ পাড়ি দিয়ে অকল্যান্ড থেকে ক্রাইস্টচার্চে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি অভিভূত। আমরা যখন নামাজ আদায় করছিলাম, তখন নিউজিল্যান্ডের হাজার হাজার মানুষ আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার কাছে মনে হয় না যে আমরা আলাদা কেউ।’ তিনি আরো বলেন, ‘৫০ জনের মৃত্যু মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ওই হামলার পর এখনকার সব ধর্মের, সব বর্ণের মানুষ নিজেদের একটি সম্প্রদায় হিসেবেই আবিষ্কার করেছে।’
নামাজের সময় মুসল্লিদের পেছনে যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের অনেকের হাতেই প্ল্যাকার্ড ছিল। একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘আমরা মুসলমান ভাইদের পাশে আছি।’ জন ডেল নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘নিউজিল্যান্ডের মানুষ ঐকবদ্ধ এবং কেউ তাতে ফাটল ধরাতে পারবে না। আমরা সব সময় একে অন্যের পাশে দাঁড়াব, তা সে মুসলমান, খ্রিস্টান যে ধর্মেরই হোক না কেন।’
হ্যাগলি পার্কে গতকাল অমুসলিম নারীরাও হিজাব পরেছিল। কাপড় ছিল প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডার মাথায়ও। তিনি মুসলমানদের উদ্দেশে বলেন, ‘নিউজিল্যান্ডের মানুষ আপনাদের ব্যথায় ব্যথিত। কারণ আমরা-আপনারা সবাই এক।’ মহানবীর উদ্ধৃতি দিয়ে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সহানুভূতি কিংবা সমবেদনা একটি দেহের মতো; দেহের কোনো অংশে আঘাত লাগলে পুরো দেহই ব্যথা অনুভব করে।’
আল-নুর মসজিদের ইমাম গামাল ফউদা বলেন, ‘এখানে হামলা চালিয়ে বন্দুকধারী বিশ্বের কোটি মানুষের হূদয় ভেঙেছে। আজ সেই একই জায়গা ভরে উঠেছে সমবেদনা আর ভালোবাসায়।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বেঁচে আছি এবং একসঙ্গে আছি। কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।’
জন ক্লার্ক নামের এক পর্যবেক্ষক বলেন, ‘ক্রাইস্টচার্চের হামলা এবং আজকের এই জনসমাগম মানুষকে কিছু বিষয়ে নতুন করে ভাবাবে। আমরা সাধারণত নিজেদের আলাদা আলাদা সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যে একটা অন্ধকার দিক আছে, তা এবার অনেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন।’
এদিকে ক্রাইস্টচার্চ থেকে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল শফিকুর রহমান অণু জানিয়েছেন, গতকাল পাঁচ বাংলাদেশির জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। দুজনের পরিবার (বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. আবদুস সামাদ ও সিলেটের হোসনে আরা পারভিন) নিউজিল্যান্ডে তাঁদের মরদেহ দাফন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। তাঁদের নিউজিল্যান্ডেই কবর দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাকি তিনজনের (নারায়ণগঞ্জের ওমর ফারুক, চাঁদপুরের মোজাম্মেল হক ও নরসিংদীর জাকারিয়া ভুঁইয়া) পরিবার মরদেহ বাংলাদেশে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এ কারণে মরদেহগুলো হিমঘরে রাখা হয়েছে।’
ওই তিনজনের মরদেহ কবে নাগাদ বাংলাদেশে পৌঁছতে পারে জানতে চাইলে অনারারি কনসাল জানান, এটি নির্ভর করছে তাঁদের স্বজনরা মরদেহ কবে নেবে তার ওপর। কিছু আনুষ্ঠানিকতাও আছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন