ঘাট পেরিয়ে ত্রুটি দেখা দেয় ইঞ্জিনে, ব্যবস্থা নেননি মালিক-চালকরা | There was an error in the engine after crossing the ghat, the owners and drivers did not take action
ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চের ইঞ্জিনে ত্রুটি ছিল। অগ্নিকাণ্ডের আগে ত্রুটি ধরা পড়লেও সারাতে কোনো ব্যবস্থা নেননি মালিক-চালকরা। চাঁদপুর ঘাট পার হওয়ার পরই ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়। আগুন লাগার পর যাত্রীদের নিরাপদে নামার ব্যবস্থা না করে উল্টো নিজেরা পালিয়ে যান।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে এসব কথা উঠে এসেছে। গত সোমবার রাতে মন্ত্রণালয়ে এই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এতে অগ্নিকাণ্ড এড়াতে ২৫ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। কম লঞ্চ চালিয়ে বেশি মুনাফার ‘রোটেশন’ প্রথার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করে ওই প্রথা বন্ধের সুপারিশ করেছে কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সদরঘাটে কর্মরত নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল। গতকাল মঙ্গলবার নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের বলেন, কমিটি দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেছে। সেই সঙ্গে তারা কিছু সুপারিশ করেছে।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘মালিক-সুকানিদের দুর্বলতা পাওয়া গেছে। লঞ্চটি নির্মাণেও দুর্বলতা ছিল। দায়ী সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চ ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পৌঁছালে আগুন লাগে। এই পর্যন্ত ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে ৩১ জন। দগ্ধদের অনেকেই এখনো ঢাকা ও বরিশালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় লঞ্চের তিন মালিক ও চার মাস্টার-চালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ঘটনার পরদিন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. তোফায়েল ইসলামকে প্রধান করে প্রথমে পাঁচ সদস্যের ও পরে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। ঘটনার ১২তম দিনে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, লঞ্চটি চাঁদপুর ঘাট পার হওয়ার পর ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়। ত্রুটি সারাতে পারেননি লঞ্চের কর্মীরা। অনেক যাত্রী লঞ্চটি তীরে ভেড়ানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু মাস্টার ও ইঞ্জিনচালক লঞ্চটি চালাতে থাকেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আগুন লাগার পর লঞ্চের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় আনুমানিক ১৫ মিনিট চলার পর ঝালকাঠির ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের চর বাটারাকান্দা গ্রামে নদীর পাড়ে লঞ্চটি ভেড়ে। এখানেই লঞ্চের প্রথম শ্রেণির ইঞ্জিনচালক মাসুম বিল্লাহ, দ্বিতীয় শ্রেণির ইঞ্জিনচালক আবুল কালাম ও ইঞ্জিনকক্ষের সহকারীরা পালিয়ে যান। লঞ্চটি নোঙর করার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া গেলেও সেই চেষ্টা করা হয়নি। ফলে জোয়ারের কারণে লঞ্চটি আবার মাঝনদীতে চলে যায়। লঞ্চটি পুড়তে পুড়তে প্রায় ৪০ মিনিট পর নদীর অন্য পাড়ের দিয়াকুল গ্রামে ভেড়ে। লঞ্চটি চর বাটারাকান্দায় নোঙর করলে হয়তো আগুনের তীব্রতা এত বাড়ত না। এত যাত্রীর মৃত্যু হতো না।
দায়িত্বে অবহেলা
তদন্ত কমিটি বলেছে, নিবন্ধন সনদ অনুযায়ী লঞ্চটির দুটি ইঞ্জিনের মোট ক্ষমতা ছিল এক হাজার ১০০ অশ্বক্ষমতার (বিএইচপি)। মালিকরা নৌপরিবহন অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়ে সনদের শর্ত ভেঙে অন্য জাহাজের পুরনো তিন হাজার ৩৬ বিএইচপির ইঞ্জিন লঞ্চে সংযোজন করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় তিন মাস বসে থাকার পর লঞ্চটি চালু করা হয়। এ সময় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের জাহাজ জরিপকারক ও পরিদর্শক এবং বিআইডাব্লিউটিএর পরিদর্শকসহ কেউই ভালোভাবে লঞ্চটি পরীক্ষা করেননি।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক মাহবুবুর রশিদ লঞ্চটির ইঞ্জিন পরিবর্তনের বিষয়ে খোঁজ রাখেননি। তিনি লঞ্চটি পরিদর্শন করে চলাচলের অনুমতি দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, লঞ্চটি প্রায় তিন মাস বন্ধ থাকার পর ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা-বরগুনা রুটে প্রথম যাত্রা করে। ২৩ ডিসেম্বর ছিল দ্বিতীয় যাত্রা। সদরঘাটে দায়িত্বরত নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পরিদর্শক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯ ও ২৩ ডিসেম্বর লঞ্চটি পরিদর্শন করেননি।
এতে আরো বলা হয়, লঞ্চটির যান্ত্রিক ত্রুটি সারানোর পর আবার চালুর বিষয়টি জানা সত্ত্বেও বিআইডাব্লিউটিএর নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের জাহাজ জরিপকারককে বিষয়টি না জানিয়ে যথাযথ ভূমিকা পালন করেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিআইডাব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক দিনেশ কুমার সাহা অভিযান-১০ লঞ্চকে ‘ত্রুটি নেই’ বলে যাত্রা শুরুর অনুমতি দিয়েছিলেন। তবে তাঁর নাম তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।