৬২ বছর বয়সে মাস্টার্স পাস,মা ছেলের একসাথে পিএইচডি'র আশা !

 



৬২ বছর বয়সে মাস্টার্স পাস,মা ছেলের একসাথে পিএইচডি'র আশা ! 


মাত্র ৪ বছর বয়সে মাকে হারান আরেফা হোসেন। চার বছর পর বয়স যখন আট তখন হারান বাবাকে। পাঁচ বোনের মধ্যে আরেফা ছিল তৃতীয়। অভিভাবক হিসেবে একমাত্র বড় বোন। কিন্তু এতেও ভাগ্যে আসে বিয়োগের বেদনা। অল্প বয়সে বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। পরে তার বাকী তিন বোনসহ আশ্রয় হয় একটি অনাথ আশ্রমে।


অনাথ আশ্রম থেকে ভর্তি হন মিশনারি স্কুলে। মাধ্যমিকে পড়াশোনা করার সময় বাংলা একটি সিনেমা দেখেন তিনি। যে সিনেমায় এক এতিম মেয়ে স্বেচ্ছায় মানুষকে সেবা দিচ্ছেন। সে সিনেমা থেকেই স্বপ্ন বুনতেন তিনিও একদিন সেবিকা হবেন। ১৯৭৬ সালে মাধ্যমিক পাস করে রাজশাহীর খ্রিস্টিয়ান মিশন হাসপাতালে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারিতে ভর্তি হোন। সেখান থেকে ১৯৮১ সালে শেষ করে ১৯৮২ সালের ৬ জুন ঠাকুরগাঁও মহকুমা হাসপাতালে (বর্তমানে আধুনিক সদর হাসপাতালে) নার্স হিসেবে যোগদান করেন।


চাকরির দুই বছর পরেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন তিনি। বছর না যেতেই কোলজুড়ে আসে সন্তান। যেন বেড়ে গেলো আরো দায়িত্ব কমে গেল সময়। একদিকে সংসারের ব্যস্ততা অন্যদিকে কর্মময় জীবন। এগুলো বাদ দিয়ে আলাদা কোন বিষয়ে মনোনিবেশ হওয়ার সুযোগ ছিলনা তার।


তবে মনে তার সুপ্ত বাসনা তাড়া করতো

উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে আবার শুরু হয় পড়াশোনা। বিএসসি করার জন্য ভর্তি হোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মহাখালী সেবা মহাবিদ্যালয়ে। সেখান থেকে স্নাতক শেষ করে ক্ষান্ত হননি তিনি, বরং চাহিদা বেড়েছে মাস্টার্স করার। চলতি বছরের ১৭ জুন অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন তিনি। ৬২ বছর বয়সে শিক্ষাগত সনদ অর্জনে যেন উচ্চ শিক্ষার স্বাদ শেষ বয়সে আশ্বাদন করলেন তিনি। এত বয়সে উচ্চ শিক্ষায় সাড়া পরেছে জেলার অন্যান্য  শিক্ষার্থীদের মাঝে।


ঠাকুরগাঁও পৌরসভার ইসলামবাগের বাসিন্দা আরেফা হোসেন। তিন বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে বর্তমানে দুই ছেলে সন্তান নিয়ে পরিবার তার। ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে ৩৮ বছরের চাকরিজীবন শেষ করে ঠাকুরগাঁও নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি।


একদিকে বয়সের ভার, অন্যদিকে পরিবার ও কর্মস্থলের ব্যস্তময় সময়। এ বয়সে পড়াশোনা যেন আকাশকুসুম বিষয়। তবুও সব বাধা ডিঙিয়ে উচ্চ শিক্ষার সনদ পেয়ে আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন আরেফা হোসেন।


আরেফা হোসেন বলেন, আমার জন্ম

নওগাঁ জেলায়। সেখানেই আমাদের বাড়ি ছিল। আমরা পাচঁ বোন ছিলাম। ছোট বেলায় মা-বাবা মারা যায়। বড় বোন আমাদের দেখাশুনা করতেন। কিছুদিন পরে বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। তখন আমাদের দেখাশোনা করার মত কেউ ছিলনা। আমি সহ আমরা তিনবোন সেখানে এক অনাথ আশ্রমে থাকা শুরু করি। সেই অনাথ আশ্রমেই সময়টা কেটেছে। এক বদ্ধপরিকর জীবন কেটেছে আমাদের। আর যেহেতু এতিম সেহেতু এর বাইরে আলাদা ভাবে জীবন কাটানোর কোন সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ছোটবেলা থেকে সবার মনে বড় হয়ে কিছু হওয়ার ইচ্ছে থাকে। তবে আমার স্বপ্ন বা ইচ্ছেটা ছিল একটু অন্যরকম।


যেহেতু মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেছি সেখানেই থেকেছি। আমি একটি বাংলা সিনেমা দেখেছিলাম। সিনেমায় এক বাবা-মা হারানো মেয়ে মানুষকে সেবা দিচ্ছেন। সেই সিনেমার সেই চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও মনে মনে ভেবেছিলাম যে আমিও মানুষের সেবা করব। সেবিকা হিসেবে আমিও মানুষের পাশে থাকব। তারপরে নার্সিং কলেজে ভর্তি হয় সেখানে পড়াশোনা শেষ করি।


‘যখন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন খুব অসহায় হয়ে পরে। সে মানুষ যে পরিবারের হোক বা যতই ধনবান হোক। কথায় আছে স্বাস্থ্যই সম্পদ বা স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। এ পেশায় থাকাকালীন বিভিন্ন রোগী ও তাদের পাশে দাড়ানোর সুযোগ হয়েছে। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে থেকে একজন সেবিকা পেশাটা মহৎ পেশা বলে আমি মনে করছি। যে পেশায় মানুষের খুব কাছ থেকে সহযোগিতা করা যায়।’


তিনি আরো বলেন, আমার ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার। কিন্তু চাকরির পরে বিয়ে তারপর সন্তান হয়ে যায়। মনে হয়েছিল হয়তো আর উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবনা। তবে আমার স্বামী আমার শক্তি জোগান দিয়েছেন। তার অনুপ্রেরণায় আমি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। তিনি আমাকে বলেছিলেন উচ্চ শিক্ষার যেহেতু সুযোগ আছে তুমি ভর্তি হয়ে যাও। আমি এ বয়সে মাস্টার্স করেছি আমার স্বামীর অনুপ্রেরণায়। যদিও তিনি জানেন আমি মাস্টার্স করছি কিন্তু আমার সফলতা তিনি দেখে যেতে পারেননি। ২০১৯ সালে তিনি মারা গেছেন। আর আমি এ বছরে মাস্টার্স শেষ করে সনদ পেলাম। আসলে জীবন মানে সংগ্রাম। কথায় আছে যে রাধে, সে চুলও বাধে। আমার বড় ছেলে বলে আম্মু তুমি আর আমি একসাথে পিএইচডি করব। তারা অনেক খুশি হয়েছে।


নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী রোমানা আক্তার বলেন, আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ম্যাম চাকরি করছেন। অনেক সুন্দর করে তিনি আমাদের ক্লাসে পাঠদান করান। উনার ক্লাসে মনোযোগ থাকলে আলাদাভাবে বাড়তি পড়াশোনার প্রয়োজন হয়না। আর উনি আমাদের অনুপ্রেরণা। এত বছর বয়সে যদি ম্যাম উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তাহলে আমরাও পারব। আমরা সকলে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ম্যামের সফলতা দেখে।


আরেফা হোসেনের ছোট ছেলে আদিব হোসেন বলেন, আম্মুর সফলতায় আমরা অনেক খুশি। আমরা সন্তান হিসেবে আম্মুকে নিয়ে গর্ববোধ করেছি। আমরা মা ছেলে একসাথে পিএইচডি করব।


ঠাকুরগাঁও পৌরসভার কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন বয়স একটি সংখ্যা মাত্র। যদি স্বপ্ন দেখা যায় আর পরিশ্রম করা হয় তবে সফল হওয়া সম্ভব। আমি তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। তিনি যাতে তার অর্জিত শিক্ষা নতুন প্রজন্মের কাছে বিলিয়ে দিতে পারেন।


আরো পড়ুন:


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Holy Foods ads

Holy Foods ads

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget