রাশিয়া-ইউক্রেনের বৈঠকের আগে যে আশা প্রকাশ করলেন এরদোগান
তুরস্কে রুশ-ইউক্রেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে শান্তি আলোচনা আজ
Russia-Ukraine Foreign Minister-level peace talks in Turkey today
রুশ ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা তুরস্কে শান্তি আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন বৃহস্পতবার। ইউক্রেনে রুশ হামলার পর এটিই হবে উভয় পক্ষের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠক। এতে অংশগ্রহণ করবেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও।
দু’দেশের প্রতিনিধিরা ইতোমধ্যে তুরস্কে পৌঁছেছেন। তুরস্কের আনাতোলিয়া শহরে উভয়পক্ষের এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িফ এরদোগান রুশ-ইউক্রেন আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছেন। তিনি আশা করছেন, আলোচনার মধ্য দিয়ে রক্তক্ষয়ী এ সংকট মোকাবেলা সম্ভব হবে। এছাড়া এটি অস্ত্রবিরতিতেও সহায়ক হবে।
আরো পড়ুন: তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে গ্যাস বন্ধের হুমকি রাশিয়ার
এর আগে উভয়পক্ষের মধ্যে বেলারুশে একাধিক বৈঠক হয়েছে। তবে সেসব বৈঠকে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অংশ নিলেও রাশিয়ার মন্ত্রী পর্যায়ের কেউ অংশ নেয়নি।
আনাতোলিয়ার এ বৈঠকে থাকছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুশওলুও। ন্যাটো সদস্য তুরস্কের সাথে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়েরই রয়েছে ভালো সম্পর্ক।
রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে। দু’সপ্তাহের অব্যাহত রুশ হামলায় ইউক্রেনের লাখ লাখ লোক প্রতিবেশী দেশসমূহে আশ্রয় নিয়েছে।
দু’দেশের অব্যাহত যুদ্ধের মধ্যেই তুরস্কে এ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
শান্তির পথে অগ্রগতি
ইউক্রেন ও রাশিয়া রণাঙ্গনে মুখোমুখি লড়াই চালিয়ে গেলেও যুদ্ধ বন্ধ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চলছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যকার শান্তি আলোচনায় বেশ অগ্রগতি হয়েছে। পরস্পরের দাবিগুলো চুলচেরা পর্যালোচনা করছেন তারা। মস্কো ও কিয়েভের পক্ষ থেকে পরিস্কার করে বলা না হলেও উভয় পক্ষ শান্তি স্থাপনে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। এ অবস্থায় রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ও ইউক্রেনীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা আজ তুরস্কে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বসছেন। আশা করা হচ্ছে, এ বৈঠকে তাদের দূরত্ব আরও কমতে পারে।
এরই মধ্যে গতকাল দোনেৎস্ক অঞ্চলে মারিউপোল মা ও শিশু হাসপাতালে বিমান হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ১৭ শিশু আহত হয়েছে। ইউক্রেনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ওই হাসপাতালে রাশিয়া বিমান হামলা চালিয়েছে। তবে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মস্কোর পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
গতকাল ওয়াশিংটন সফররত ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস বৈঠক করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সঙ্গে। পরে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, হাসপাতালে হামলা একেবারে ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। আমরা পুতিনকে ইউক্রেনে ব্যর্থ করা এবং দেশটির সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার না করা পর্যন্ত বিশ্রাম নেব না।
হামলায় শিশু ওয়ার্ড ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, এখনও হাসপাতালের ধ্বংসস্তূপের নিচে বহু শিশু রয়েছে। নৃশংসতা ! বিশ্ব আর কতদিন সন্ত্রাসকে উপেক্ষা করে সহযোগী হয়ে থাকবে? পরে তিনি ফের ইউক্রেনকে নো ফ্লাই জোন ঘোষণার দাবি করেন।
যুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক সমাধানের জন্যও চেষ্টা চলছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট গত কয়েক দিনের মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে শান্তি স্থাপন বিষয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা করেছেন। তার ভিত্তিতে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা গতকাল জানিয়েছেন, আলোচনা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।
আরো পড়ুন: নাবিক ইউক্রেন থেকে উদ্ধার ২৮ বাংলাদেশি নাবিক দেশে ফিরছেন আজ
ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের উদ্ৃব্দত করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওসের খবরে বলা হয়েছে, 'দুই পক্ষের মধ্যেই অবস্থান নরম হতে দেখা গেছে।' খবরে বলা হয়েছে, রুশ পক্ষ বলছে, তারা শুধুই দোনবাস অঞ্চলকে অসামরিকীকরণ করতে চায়।
যদিও এর আগে রুশ অভিযানের শুরুতে পুতিন বলেছিলেন, ইউক্রেনের অসামরিকীকরণ ও নাৎসিমুক্ত করাই রাশিয়ার সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য। তিনি আরও বলেছিলেন, ইউক্রেনকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে ক্রিমিয়াকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং লুহানস্ক ও দোনেৎস্কের স্বাধীনতাকেও স্বীকৃতি দিতে হবে।
ইসরায়েলের কর্মকর্তারা বলছেন, জেলেনস্কির পক্ষে পুতিনের এ প্রস্তাব মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। তবে এতে কিয়েভে ক্ষমতার পরিবর্তনের কথা নেই এবং ইউক্রেনকেও তার সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, জেলেনস্কি সরাসরি পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছেন। কিয়েভ বলছে, কূটনৈতিক সমাধানে প্রস্তুত রয়েছে ইউক্রেন।
ইসরায়েলি দৈনিক জেরুজালেম পোস্ট কিছু সূত্রকে উদ্ৃব্দত করে বলছে, রুশ প্রস্তাবটি চূড়ান্ত এবং জেলেনস্কি এটি না মানলে পুতিন সামরিক অভিযান তীব্রতর করবেন।
গতকাল ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও বলা হয়েছে, আলোচনা চলছে। শিগগিরই দু'পক্ষের প্রতিনিধিরা ফের মুখোমুখি বৈঠকে বসবেন।
রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিধ্বংসী যুদ্ধের মধ্যে সুর নরম করেছেন জেলেনস্কিও। গত সোমবার এবিসি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার জন্য তিনি আর চেষ্টা করবেন না। অথচ তার দেশে রাশিয়ার হামলার প্রধান যুক্তিই এটি। একই সঙ্গে জেলেনস্কি বলেছেন, দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের বিষয়েও ছাড় দিতে রাজি আছেন তিনি। অর্থাৎ এ দুই অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাশিয়ার যে দাবি, সেটি তিনি মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
গতকাল ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনের সরকার পরিবর্তন করতে চায় না। এটি এই শান্তি আলোচনায় বড় ধরনের অগ্রগতি ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে বলে আশা করা হচ্ছে। এ আলোচনার মধ্যস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে আঙ্কারা। তারাও সমঝোতার ব্যাপারে আশাবাদী। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আশা করছেন, আনতালিয়ার আজকের বৈঠকে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির একটি পথ খুলে যাবে।
গতকাল রুশ প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিনের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেছেন আফ্রিকান ইউনিয়নের (এইউ) প্রধান ও সেনেগালের প্রেসিডেন্ট ম্যাকি শল। এ সময় তিনি পুতিনকে যুদ্ধবিরতি স্থায়ী করার আহ্বান জানিয়েছেন। পরে এক টুইটবার্তায় তিনি বলেন, এইউ প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনকে স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে চাপ দেওয়ার জন্য আজ (বুধবার) সকালে ফোন দিয়েছিলাম। তিনি (পুতিন) মনোযোগ সহকারে বক্তব্য শুনেছেন এবং যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে যেতে সমঝোতামূলক আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
আরো পড়ুন: যা থাকছে নিপুণের ওয়েব সিরিজ ‘সাবরিনা’য় (ভিডিও)
পরে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত এবং উভয় পক্ষকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেয় এইউ। পাশাপাশি তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে উন্মুক্ত আলোচনার দাবি জানায় সংস্থাটি।
শরণার্থী বেড়ে সাড়ে ২১ লাখ :ইউক্রেনে রুশ হামলায় অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তুর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাপক হারে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। মঙ্গলবার চার শহরে ১২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির পর গতকাল ছয় শহরে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় মস্কো-কিয়েভ।
মঙ্গলবার সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার কারণে বহু মানুষ সংঘাতকবলিত এলাকা ছাড়তে সক্ষম হয়েছে। গতকাল জাতিসংঘ জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় তাদের ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করে এক লাখ ৪৩ হাজার ৯৫৯ জন শরণার্থী হয়ে ইউক্রেন ছেড়েছেন। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে সাড়ে ২১ লাখ মানুষ দেশ ছেড়েছে। দেশছাড়া ইউক্রেনীয়দের অর্ধেকের বেশি প্রতিবেশী পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে, রুশ হামলায় উদ্বাস্তু হয়ে বর্তমানে ১২ লাখ ৯৪ হাজারের বেশি মানুষ পোল্যান্ডে অবস্থান করছে।
ছয় শহরে যুদ্ধবিরতি :বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, কিয়েভ, সুমি, ইজিয়াম, ইনারোদার, মারিউপোল ও ভলনোভাখা- এই ছয় শহরে সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। গতকাল স্থানীয় সময় সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলে এই যুদ্ধবিরতি। রাশিয়ার আক্রমণ ও ইউক্রেনের প্রতিরোধের মধ্যে অবরুদ্ধ এসব শহর থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে এ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় তারা। সূত্র বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স, স্পুটনিক নিউজ ও ইন্টারফ্যাক্স।