‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন আর নেই | Kazi Anwar Hossain, the creator of 'Masood Rana' is no more
বাংলাদেশের স্পাই থ্রিলার জগতে জনপ্রিয়তম চরিত্র ‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন আর নেই।
ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার তার মৃত্যু হয়েছে। তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
কাজী আনোয়ার হোসেন একাধারে ছিলেন অনুবাদক, প্রকাশক, চিত্রনাট্যকার। গানও গাইতেন তিনি। তবে সব কিছু ছাপিয়ে তার পরিচয় ছিল সেবা প্রকাশনীর প্রকাশক এবং এই প্রকাশনার সিরিজ মাসুদ রানার লেখক। আর পাঠকের কাছে তিনি ছিলেন ‘কাজীদা’।
গণিতজ্ঞ, দাবাড়ু অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের ছেলে কাজী আনোয়ার হোসেন দুই ছেলে কাজী শাহনূর হোসেন ও কাজী মায়মুর হোসেন এবং মেয়ে শাহরীন সোনিয়াকে রেখে গেছেন। তার বোনদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক সনজীদা খাতুন।
কাজী আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন আগেই মারা যান। ফরিদার এক বোন খ্যাতিমান সঙ্গীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। তাদের আরেক বোন সঙ্গীতশিল্পী নীলুফার ইয়াসমিন মারা গেছেন।
ঢাকার বারডেম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটে কাজী আনোয়ার হোসেনের মৃত্যু হয় বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান তার পুত্রবধূ মাসুমা মায়মুরা।
গত বছরের অক্টোবরে প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়লে কয়েক দফায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন।
মায়মুরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত বছরের অক্টোবর থেকে তিনি প্রোস্টেট ক্যান্সারে ভুগছেন। শরীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১০ দিন তাকে ‘লাইফ সাপোর্টে’ রাখা হয়েছিল। লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় একটা ব্রেইন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক হয়ে সব শেষ হয়ে গেল।”
কাজী আনোয়ার হোসেনের চাচাত ভাই কাজী রওনাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মরদেহ বুধবার বারডেরমে হিমঘরে থাকবে। বৃহস্পতিবার সকালে সেগুনবাগিচার বাসায় মরদেহ নেওয়া হবে। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বাদ আসর বনানী কবরাস্থানে মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে।
বাংলাদেশে রহস্য উপন্যাস জনপ্রিয় করার কারিগর কাজী আনোয়ার হোসেন নিজের জীবনও অনেকটা রহস্যময় করে রেখেছিলেন। প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যেত না বললেই চলে, গণমাধ্যমও এড়িয়ে চলতেন। সাক্ষাৎকার দিতেনও কালেভদ্রে। তাই তাকে নিয়ে রয়েছে নানা গল্পও।
কাজী আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ও সাজেদা খাতুনের ঘরে।
থেকে। এরপর বাংলায় এমএ ডিগ্রি নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
পড়াশোনা শেষ করে গানে মনোযোগী হয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। তার তিন বোন সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন তখন শিল্পী হিসেবে পরিচিত।
১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সিনেমায় প্লেব্যাকও করতেন। ১৯৬২ সালে বিয়েও করেন কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনকে।
গান ছেড়ে গত শতকের ষাটের দশকে প্রকাশনা ব্যবসায় নামেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সেগুনবাগিচায় নিজেদের বাড়িতে গড়ে তোলেন সেগুনবাগান প্রেস। সেটাই পরে নাম পাল্টে হয় সেবা প্রকাশনী।
সেবা প্রকাশনীর মাধ্যমেই পেপারব্যাক বই বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পায়। গোয়েন্দা সিরিজ কুয়াশা দিয়ে সেগুনবাগান প্রকাশনীর যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপরে আসে মাসুদ রানা।
“বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে...কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর, সুন্দর এক অন্তর। একা। টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না।’- এমন এক চরিত্র তিনি তৈরি করেন, যা খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ইয়ান ফ্লেমিংয়ের জেমস বন্ডের আদলে গড়ে তোলা মাসুদ রানার সব বইই বিদেশি বিভিন্ন থ্রিলারের ছায়া অবলম্বনে লেখা।
ফলে সাহিত্য হিসেবে তা গ্রহণ করা নিয়ে অনেকের অনীহাও ছিল। এগুলো চটুল বা লঘু জ্ঞান করে সাহিত্যের আলোচনায় সরিয়েই রাখা হত।
এ নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে কাজী আনোয়ার হোসেন বলছিলেন, “আমার খাতিরে বা আমার মুখ চেয়ে পাঠকেরা এসব বই কিনে পড়ছেন, ব্যাপারটা তা তো নয়, নিশ্চয়ই এসব কাহিনির ভেতর অন্তর্নিহিত বিশেষ কিছু আকর্ষণ ও আবেদন রয়েছে, যেগুলো সমালোচকদের চোখ এড়িয়ে গেছে।
“তা না হলে যেসব সুসাহিত্যিক এত দিন মাসুদ রানার প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে নিজেদের অনেক উঁচুতে তুললেন, এতগুলো বছর চেষ্টা করেও তারা কি পাঠকদের এসব বাজে লেখা থেকে সরিয়ে নিজেদের লেখার প্রতি টানতে পেরেছেন? না।”
মাসুদ রানার জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে তা রুপালি জগতও তাকে নিয়ে ঋদ্ধ হতে চেয়েছে। ১৯৭৪ সালে মাসুদ রানার প্রথম চলচ্চিত্রায়ন ঘটে সিরিজের ‘বিস্মরণ’ বইটি নিয়ে। কল্পনার মাসুদ রানার ভূমিকায় এসেছিলেন সোহেল রানা, সেটাই এই চিত্রনায়কের প্রথম সিনেমা।
আর মাসুদ রানার জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতার বাচসাস পুরস্কার জেতেন কাজী আনোয়ার হোসেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্যাকেজ নাটকের শুরুতেও জড়িয়ে মাসুদ রানা। সিরিজের পিশাচ দ্বীপ নিয়ে আতিকুল হক চৌধুরী তৈরি করেন নাটক প্রাচীর পেরিয়ে, যাতে মাসুদ রানার ভূমিকায় ছিলেন নোবেল, তার সঙ্গী সোহানা হয়েছিলেন বিপাশা হায়াৎ।
মাসুদ রানাকে নিয়ে আরও দুটি চলচ্চিত্রও এখন নির্মাণের অপেক্ষায় রয়েছে।
মাসুদ রানার পাশাপাশি অনেক বই অনুবাদও করেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। তার সম্পাদিক রহস্য পত্রিকাও বেশ জনপ্রিয় সাময়িকী। পরে বের করেন কিশোর পত্রিকা।
মাসুদ রানা সিরিজের কয়েকশ বই বের হলেও এর অনেকগুলো নিজে লেখেননি কাজী আনোয়ার হোসেন। ‘ঘোস্ট রাইটার’ হিসেবে অন্যরা লিখতেন, তবে লেখকের নাম যেত কাজী আনোয়ার হোসেন।
এনিয়ে শেষ জীবনে বিতর্কও সঙ্গী হয়েছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের। সেবা প্রকাশনীরই লেখক শেখ আব্দুল হাকিম মাসুদ রানার স্বত্ব দাবি করলে বিষয়টি আদালতেও গড়িয়েছিল।
শেষে হাই কোর্ট মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি এবং কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে মালিকানা স্বত্ব শেখ আবদুল হাকিমকে দিয়ে আদেশ দেয়।
অধিকাংশ বইয়ের মালিকানা হারালেও ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের স্রষ্টা হিসেবে চরিত্রটি কাজী আনোয়ার হোসেনের মালিকানায় থাকবে বলে সিদ্ধান্ত দেয় কপিরাইট অফিস।
নানা সমালোচনার মধ্যেও নিজের লেখালেখি নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন বলে গেছেন, “লঘু বলেন বা বলেন অকিঞ্চিৎকর সাহিত্য; আমি আমার ভালোবাসার জগতে দিব্যি আরামে ও আনন্দে বিচরণ করছি আজীবন।”