গত চল্লিশ বছরে চীনে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। দেশটি পরিচিত হয়ে উঠেছে বিশ্বের মেগা কারখানা হিসাবে। চীনের এই অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে অনেকে 'অলৌকিক অর্থনীতি' বলে থাকে। যার মূল চালিকাশক্তি বিশাল এক অভিবাসী কর্মী বাহিনী। এই শক্তি দেশটির গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে কাজ করতে যাওয়া লাখো লাখো মানুষের জনবল।
কিন্তু এর জন্য চীনের গ্রামীণ জনপদগুলোকে কী মূল্য দিতে হয়েছে? চীনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সেই প্রতিচ্ছবিকে ফুটিয়ে তুলেছেন এক চীনা লেখিকা তার নিজের গ্রামের আয়নায়।
শাংহাই পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত পরিবর্তনশীল শহরগুলোর একটি। কিন্তু যারা এই শহরের আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলো তৈরি করছেন, যাদের শ্রমে তৈরি নানাধরনের পণ্যসামগ্রী এই শহরেরই বন্দর থেকে পাড়ি জমাচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে, তারা চীনের গ্রাম ছেড়ে শহরে কাজ করতে যাওয়া মানুষের ঢল।
চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেভাবে ঘটেছে তা দ্রুততা এবং বিশালতার দিক দিয়ে এতটাই যুগান্তকারী যে, প্রায়ই একে ব্যাখ্যা করা হয় একটা অলৌকিক ঘটনা বা 'মিরাকল' হিসাবে।
বহু বছরের অর্থনৈতিক স্থবিরতা আর দারিদ্রের মধ্যে দিয়ে সময় পার করার পর একদলীয় কম্যুনিস্ট এ রাষ্ট্রটি ১৯৭০ এর শেষ দিক থেকে অর্থনীতি উন্মুক্ত করতে ও সংস্কারের পথে হাঁটতে শুরু করে।
চীনের প্রাচীন হুকো পদ্ধতিএর আগে পর্যন্ত চীনের মানুষ ছিল হুকো পদ্ধতিতে বন্দি। এই হুকো-র আওতায় মানুষের স্বাধীনভাবে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যাওয়ার অধিকার ছিল না।
চীনা লেখিকা লিয়াং হং বিবিসিকে বলছিলেন এই হুকো হল মানুষকে এলাকা ভিত্তিতে নথিভুক্ত করার বহু প্রাচীন একটা পদ্ধতি। এতে পরিবারগুলোকে এলাকা ভিত্তিতে নথিবদ্ধ করা হয় এবং পরিবারের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত হয় এই ব্যবস্থার অধীনে।
‘১৯৫০ থেকে ৭০ এর দশকের শেষ পর্যন্ত চীনের ভেতরে মানুষের চলাচলের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ ছিল। এলাকা থেকে বেরনোর জন্য প্রত্যেককে অনুমতি নিতে হতো। নিজের শহর বা গ্রাম থেকে অন্য এলাকায় যেতে হলে ভ্রমণের জন্য বিশেষ অনুমতিপত্র লাগত,’ বলছেন লিয়াং হং।
কিন্তু ৮০’র দশক থেকে এই বিধিনিষেধ উঠে যেতে শুরু করে। ফলে দেশের ভেতরে যেখানে ভাল কাজের সুযোগ সুবিধা আছে সেখানে মানুষের স্বাধীনভাবে যাওয়ার পথ খুলে যায়।
আর এ কারণেই চীনের ভেতরেই হঠাৎ করে শহরমুখী অভিবাসনের একটা ঢল নামে বলে বলছেন বেইজিংএ রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা সাহিত্যের অধ্যাপক লিয়াং হং।
তিনি বড় হয়েছেন চীনের হুবেই প্রদেশে লিয়াং নামে এক গ্রামে। ওই গ্রামে ছিল তাদের বড় পরিবার। তারা ছিলেন ছয় ভাইবোন।
লিয়াং বলছিলেন, শহরে অভিবাসী কর্মীদের কাজ করার অনুমতি যখন ছিল না, তখন গ্রামে তার মত পরিবারের বাপমায়েরা গোটা পরিবারের ভরনপোষণ করতে হিমশিম খেতেন।
‘এরপর হঠাৎই অর্থনীতিতে একটা জোয়ার এলো, বিশেষ করে উপকূলবর্তী এলাকায়। গ্রামের মানুষদের জন্য এসব শহরের কারখানাগুলোয় গিয়ে কাজ করার বিরাট একটা সুযোগ তৈরি হল। তাদের জন্য ভাল আয়-রোজগারের পথ খুলে গেল। তারা গ্রামে উপার্জনের অর্থ পাঠাতে শুরু করল, তাদের পুরো পরিবারের জীবনের মান উন্নত হতে শুরু করল।’লিয়াং হং যে উপকূল এলাকার কথা বলছেন, সেটি দক্ষিণ চীনের গুয়াংডং প্রদেশে এবং পরিচিত পার্ল নদীর বদ্বীপ এলাকা নামে।
এটি পৃথিবীর অন্যতম সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ একটি শহর এলাকা, যে এলাকা কারখানায় ঠাসা। সেখানকার অসংখ্য কারখানায় তৈরি পোশাকআশাক ও অন্যান্য পণ্য সামগ্রী সেখান থেকে চালান যায় সারা বিশ্বের নানা দেশে।
কিন্তু সেখানকার লাখ লাখ মানুষ এসেছেন বিভিন্ন গ্রাম থেকে, যাদের বসতি হুকো ব্যবস্থায় নথিভুক্ত তাদের গ্রামে।
এরাই চীনের ভাসমান কর্মশক্তি - অভ্যন্তরীণ অভিবাসী।
ধারণা করা হয়, চীনে ২৫ কোটির বেশি মানুষ কাজের জন্য নানা শহরে গিয়ে বসতি গড়েন। এরা দেশটির মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ।
লেখিকা লিয়াং হং বলছেন, এই অভিবাসী জনগোষ্ঠীর শহরে কাজ করার সুযোগ তৈরি হওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতিতেও প্রবৃদ্ধির ছোঁয়া লেগেছে, কিন্তু গ্রামীণ জীবনে এর ফলে ঘটে গেছে ব্যাপক ওলটপালট।
মানসিক একাকীত্বে তরুণ সমাজলিয়াং হং বলছেন, গ্রাম থেকে বিশাল সংখ্যক মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে গেছেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কারণে পরিবার ও সন্তানদের তারা গ্রামেই রেখে আসতে বাধ্য হয়েছেন। পরিবারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
‘সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে তাদের শিক্ষার কারণে। যারা গ্রামের বাসিন্দা, শহরের হুকো ব্যবস্থায় তাদের নাম নথিভুক্ত নেই, কারণ তারা শহরের স্থায়ী বাসিন্দা নন। ফলে যে শহরে বাবার কর্মস্থল, সেখানে তাদের ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই তারা পড়ে থাকছে গ্রামে- বড় হচ্ছে দাদী, নানীর কাছে। তারাও সাধ্যমত তাদের মানুষ করার চেষ্টা করছেন,’ বলছেন লিয়াং।
পড়াশোনার ফাঁকে লিয়াং হং হুবেই প্রদেশে নিয়মিত তার পূর্বপুরুষের গ্রামে যেতেন। তিনি দেখতেন বৃদ্ধ দাদা, নানারা তখনও খেতখামারে কৃষিকাজ করছেন, পাশাপাশি একাধিক শিশুর লালনপালনের গুরুদায়িত্বও পালন করছেন তারা।
‘বুড়ো বয়সে কঠিন জীবন টানছেন তারা, যে জীবন এমনকি একটা তরুণ দম্পতির জন্যও কঠিন।’
লিয়াং বলছেন, দাদা বা নানারা তাদের দেখাশোনা করলেও, মা-বাবা সাথে না থাকার ফলে এসব ছেলেমেয়ের জন্য নানাধরনের সামাজিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলছেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গ্রামভিত্তিক এই সংসারগুলোয় পারিবারিক বন্ধন তৈরি হচ্ছে না।
‘এসব ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শেষ করে হয়ত বাবার পদাঙ্কই অনুসরণ করবে- নিজেও শহরে কাজের খোঁজে ছুটবে। কিন্তু বেড়ে ওঠার বছরগুলোতে তারা একা। বাপ-মায়ের সাথে তাদের কোনো বন্ধন নেই- বরং তৈরি হচ্ছে একটা বিশাল মানসিক দূরত্ব। পরিবারের স্বাভাবিক কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে। একটা গোটা প্রজন্ম একাকীত্বের শিকার।
‘আমি অবশ্য এটা বলছি না যে গ্রাম এলাকার সব তরুণই মানসিকভাবে একাকী, তাদের সবারই আবেগ অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে, তারা গভীর নিঃসঙ্গতায় ভুগছে। কিন্তু আমি বলছি এদের সংখ্যাও কিন্তু নেহাত কম নয়,’ বলেছেন লিয়াং হং।
চীনের বিভিন্ন গ্রামে এ ধরনের লাখো লাখো তরুণ-তরুণী মা-বাবার সান্নিধ্য না পেয়ে বড় হচ্ছে। তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
লিয়াং হং বলছেন, এটা বিশাল একটা সমস্যা। ‘সন্তানদের জীবন সম্পর্কে শিক্ষা দেয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে মা-বাবা তাদের পাশে থাকতে পারছেন না। কারণ সরকারি ব্যবস্থার বাইরে এসব বাবা-মায়ের শহরে সন্তানকে কাছে রেখে বড় করার আর্থিক সামর্থ্য নেই।’
চীনের গ্রামীণ জীবন কীভাবে বদলে যাচ্ছে তার একটা খতিয়ান রাখতে শুরু করেছিলেন লিয়াং হং। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তার বই 'চায়না ইন ওয়ান ভিলেজ'- এক গ্রামে গোটা চীন।
গ্রামে তারা বাবার প্রতিবেশি ও যেসব পরিবারের সান্নিধ্যে তিনি বড় হয়ে উঠেছিলেন তাদের কাহিনী, তাদের অভিজ্ঞতা যা তিনি সংগ্রহ করেছিলেন, সেসবই তার এই বইয়ের উপজীব্য। চীনে বইটি বেস্ট সেলার হয়েছে, কারণ চীনের অসংখ্য মানুষ বইয়ের পাতায় নিজেদের জীবনের প্রতিফলন দেখেছেন।
‘সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এই বইয়ে যিনি গল্প বলছেন - অর্থাৎ আমি- কোনো কল্পিত চরিত্র নই- আসল রক্তমাংসের মানুষ। ওই গ্রামের সাথে জড়িয়ে আছে আমার আবেগ। তাই ওই গ্রামের স্মৃতি আমার বইয়ের পাতায় পাতায় - সেখানে আমি বড় হয়েছি, খুব কাছ থেকে গ্রামটাকে দেখেছি। গ্রামের পরিবর্তন আমি নিজের চোখে দেখেছি।’
শুধু সামাজিক আর অর্থনৈতিক পরিবর্তনই নয় এমনকি উন্নয়নের ফলে যেসব ভৌগলিক পরিবর্তন ঘটেছে তাও উঠে এসেছে লিয়াং হংএর বইয়ে।
তিনি বলেছেন ছোটবেলায় যে নদী ছিল তার জীবনের সঙ্গী- তার কিশোরী বয়সে যে নদীর পাড়ে গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় সারা গাঁয়ের মানুষ জড়ো হতেন, আনন্দ করতেন, নদীতে নেমে তারা সাঁতার কাটতেন, নব্বইয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে সে নদী এখন চরম দূষণের শিকার।
‘দুর্গন্ধের কারণে সেখানে আজ যাওয়া যায় না। নদীর রং বদলে গেছে। নির্মাণ কাজের জন্য নদী থেকে বালু তোলা শুরু হয়েছে। গোটা নদী এলাকা আজ ধ্বংসের শিকার।’
লিয়াং হং বলেন, তিনি পাঠকদের সরাসরি তার গ্রামে নিয়ে যেতে চান, গ্রামের মানুষের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে দেখাতে চান চীনের এই বিশাল অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গ্রামগুলোকে কী মাশুল দিতে হয়েছে।
তিনি বলছেন, তিনি প্রাচীনপন্থী নন। পুরনোকে আঁকড়ে ধরে থাকার আবেগের বিষয় এটা নয়।
‘গ্রাম যদি টিকে থাকার উপযুক্ত না হয়, সে কারণে যদি গ্রামীণ জনপদের মৃত্যু ঘটে, আমি সেটা মেনে নেব। কিন্তু মানুষের আরো সৃজনশীল হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। ভাবা উচিত গ্রামীণ অর্থনীতিকে কীভাবে আরো চাঙ্গা করা যায়, কীভাবে গ্রামগুলোতে বা তার ধারেকাছে আরো কর্মসংস্থান করা যায়,’ বলছেন লিয়াং হং।
তিনি বলছেন, সব কারখানা যদি দেশের দক্ষিণে উপকূলের শহরগুলোতে গড়ে তোলা হয়, তাহলে মানুষকে কাজের সন্ধানে শতশত মাইল পাড়ি জমাতে হবে।
তার মতে, গ্রামের আশপাশের শহরগুলোতে কাজের সুযোগ তৈরি হলে মানুষ ঘনঘন গ্রামে ফেরত যেতে পারবে - সন্তানদেরও অনেক বেশি সান্নিধ্য দিতে পারবে। গ্রামের অর্থনীতি একদিকে সমৃদ্ধ হবে, অন্যদিকে, গ্রামের জীবনের সঙ্গে তাদের একটা যোগসূত্রও তৈরি হবে। এতে গ্রামও বাঁচবে, পরিবারও বাঁচবে।
লিয়াং হং তার গ্রামের বদলে যাওয়া জীবন নিয়ে আরো দুটি বই লিখেছেন। তিনি এখন অনেক বেশি সময় কাটান নিজের গ্রামে।
চীনে উন্নয়ন ও নগরায়নের প্রভাব নিয়ে তিনি তার গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে চান। চীনা সমাজে বিশাল এই পরিবর্তনের প্রতিফলন তিনি ধরতে চান একটি গ্রামের আয়নায়।
হুবেই প্রদেশের লিয়াং গ্রামের চরিত্রগুলো এরপর কী করবে, তার মধ্যে দিয়ে চীনের সমাজ জীবনের ভবিষ্যত যাত্রাপথের ঠিকানা পাঠককে জানানো তার দায়িত্ব বলে মনে করেন লেখিকা লিয়াং হং।
সূত্র : বিবিসি