বর্তমানে মোবাইলফোন ছাড়া একমুহূর্তও চলে না কারও। যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম এখন এই মোবাইলফোন। আর এ কারণে যখনই প্রয়োজন, তখনই মানুষ মোবাইলফোন থেকে কল দেয়। এছাড়া ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমু, টেলিগ্রামেও কলের ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু সব কলই কি প্রয়োজনে দেয় মানুষ? না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কাজের চেয়ে বেশি কল আসে অকাজের। এমনকি উত্ত্যক্ত করার উদ্দেশ্যেও লোকে হামেশাই কল দেয়। এছাড়া অনেক সময় প্রয়োজনীয় কলের ক্ষেত্রেও বিরতিহীন কল দিয়ে যায় কেউ কেউ। একবারের কলের পর দ্বিতীয়বারের কলের মাঝখানে কোনো সময় নেয় না। এই ধরনের কলে অনেকেই বিরক্ত হন। ভুক্তভোগী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাকে কল দেওয়া হচ্ছে, তিনি কাজে ব্যস্ত থাকতে পারেন, ড্রাইভিং করতে পারেন, কোনো গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে থাকতে পারেন, যে সময়ে কল রিসিভ করা কোনোভাবেই সম্ভব হয় না। কেবল নিজের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিতে অন্যকে ক্রমাগত কল দেওয়াও একধরনের মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এছাড়া স্রেফ অন্যকে উত্ত্যক্ত করার জন্য কিংবা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য কেউ কেউ অহেতুক বিরতিহীন কল দেয়। এই কল দেওয়ার ক্ষেত্রে আবার কেউ কেউ রাতদিন কোনো কিছুই মেনে চলেন না। যেকোনো সময়ই কল দিয়ে বসেন। তাও একবার দুবার নয়, বারবার কল দিয়েই যান। বিষয়টিকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবরা অসৌজন্যমূলক আচরণ হিসেবে দেখছেন।
বিরক্তিকর কলের ব্যাপারে গৃহিণী ফারাহ দিবা বলেন, ‘যদি খুব প্রয়োজনীয় কল না হয়, তাহলে তো অবশ্যই বিরক্তিকর। আর একইসঙ্গে ওয়েটিং অবস্থায় বিরতিহীন কল আসতে থাকলে, ওই মুহূর্তের যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তার সঙ্গে কথায় মনোযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে প্রায় বিপাকে পড়তে হয়। কখনো কখনো ফোনকল বা ম্যাসেঞ্জারে বা হোয়াটসঅ্যাপে একসঙ্গে কল চলে আসে।’
এই গৃহিণী আরও বলেন, ‘অনেক সময় কারও কল রিসিভ করতে না পারলে পরবর্তী সময়ে আমি ব্যাক করি। কারণ কমিউনিকেশন হচ্ছে মানুষের সঙ্গে রিলেশনের একটা বড় অধ্যায়। সেদিন আমার বাসায় গেস্ট এসেছিলেন, আমি কথা বলছিলাম। ওই সময় আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ কল এলে আমি ফোনে কথা বলতে থাকি। ঠিক এই সময়েই হোয়াটসঅ্যাপেও কল চলে এলো। মনে হলো হোয়াটসঅ্যাপের কলটিতে পরে অ্যাটেন্ড করলেও চলবে। আমি গেস্টদের বিদায় দিয়ে পরে হোয়াটসঅ্যাপে কল ব্যাক করি।’
বিনা অনুমতিতে কিংবা আগে থেকে যোগাযোগ নেই এমন ব্যক্তি হঠাৎ ম্যাসেঞ্জার- হোয়াটসঅ্যাপ-ভাইবার-টেলিগ্রাম-ইমোতে অডিও বা ভিডিও কল আসাকে খুবই বিরক্তিকর বলে মনে করেন ফারাহ দিবা। তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমত অপরিচিত লোকের ফোন সেভাবে অ্যাটেন্ডই করি না। অনেকের বেশ ফ্ল্যার্টিং মুডে কথা বলার প্রবণতা থাকে। এটা আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। আজ ৪৫ বছর বয়স এখন তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু ইয়াং ছিলাম তখনো করতাম না। এটা আমার ভালো লাগে না। আর ভিডিও কল তো অবশ্যই না। পরিচিতদের সঙ্গেই ভিডিও কলে আমি কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। সেক্ষেত্রে অপরিচিত কেউ হলেতো সেটা অসৌজন্যমূলক।’
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসান ইবনে কামাল বলেন, ‘কাজে ব্যস্ত থাকার সময় বিরতিহীন কল আসতে থাকলে মনোযোগ বিঘ্নিত হয়। এটি আসলেই অনেক বিরক্তিকর।’ বিনা অনুমতিতে কেউ কল করলে কিংবা আগে থেকে যোগাযোগ নেই এমন ব্যক্তিকে হঠাৎ অডিও বা ভিডিও কলকে মোটেও ভালোভাবে দেখি না। পারমিশন ছাড়া ভিডিও কল, সেটা যত ক্লোজ পারসনই হোক, ভালো দেখায় না। আমি হয়তো বা যেকোনো একটা কাজে ব্যস্ত থাকতে পারি। কলার আমার কাছে মেসেজ করে জেনে নিতে পারেন, আমি আগ্রহী কি না। আমি আগ্রহী হলে তিনি কল করতে পারেন। অনুমতি ছাড়া বিষয়টি একদমই পছন্দ করি না।
বিরতিহীন ভয়েস কলের ব্যাপারে গণমাধ্যম কর্মী ইন্দিরা দেবনাথ বলেন, ‘এটা ডিফার করে কে আমাকে কল করছে। এখন আমার বাসা থেকে যদি কল করে কিংবা কাছের কেউ বা বোন, মা; তাহলে আমি চেষ্টা করি কলটা অ্যাটেন্ড করতে। আমি জানি, তারা অপ্রয়োজনীয়ভাবে বারবার কল করবেন না। এছাড়া খুব বেশি মানুষ সাধারণত আমাকে বারবার কল করে না।’
‘বিনা অনুমতিতে কিংবা অপরিচিত লোকের অডিও-ভিডিও কল পেলে কেমন বোধ করেন?’ এই প্রশ্নের জবাবে ইন্দিরা বলেন, ‘আমার খুব মেজাজ খারাপ হয়। এই বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একবার লিখেছিলামও। সেখানে বলেছিলাম, আমাকে ম্যাসেঞ্জারে কল দিতে হলে অবশ্যই আগে মেসেজ করে অনুমতি নিয়ে নেবেন। আসলে মোবাইল নম্বরটা তো সিলেক্টিভ পিপলের কাছে থাকে। সেক্ষেত্রে কল দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ম্যাসেঞ্জারে আমরা অনেক মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকি। তাই সেখানে সবাই তো অল্প পরিচয়ে আমাকে কল করার অধিকার রাখেন না। কল করাটা খুব বিরক্তিকর।’
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশলান ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের হেড আফতাব হোসাইন বলেন, ‘ম্যানার হচ্ছে একবার বা সর্বোচ্চ দুই বার কল দেওয়া। এরপরও যদি কেউ কল না ধরেন,তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি ব্যস্ত আছেন। তিনিই আমাকে কলব্যাক করবেন। সবচেয়ে ভালো হয় দ্বিতীয় বার কল না দিয়ে একটি মেসেজ পাঠিয়ে রাখা। কেউ যদি বারবার কল দিতে থাকে, তখন ভীষণ বিরক্ত হই। হয়তো আমি একটা মিটিংয়ে আছি, আমার কাছে বারবার কল আসছে, বিষয়টি বিরক্তিকর।’ কল রিসিভ করতে না পারলে ব্যাক করার প্রসঙ্গে এই শিক্ষক বলেন, ‘আমি যদি মিসডকল দেখি, ব্যাক করি।’
বিনা অনুমতিতে কল করা বা অপরিচিত ব্যক্তি কাছ থেকে বিরতিহীন অডিও-ভিডিও কল আসা প্রসেঙ্গ আফতাব হোসাইন বলেন,‘এটা ভীষণই ব্যাড ম্যানার। খুব বাজে একটা অভ্যাস। পারমিশন ছাড়া আমরা কখনোই সোশ্যালমিডিয়ায় ভিডিও বা অডিও কল দিতে পারি না। আমাদের আসলে সোশ্যাল মিডিয়া লিটারেসিটা ভীষণ প্রয়োজন। এটা যে একটা অন্যায় হয়ে যাচ্ছে মনের অজান্তে, এটা জানি না। এই জায়গাটাও কিন্তু আমাদের দরকার, সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা টেক্সট করতে পারি, কল দেওয়ার আগে অনুমতি নিতে পারি। সোশ্যাল মিডিয়ায় অপ্রয়োজনীয় কল অ্যাটেন্ড করি না।’
এই ধরনের অভ্যাস প্রসঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, এক রকম ব্যাপার কাজ করে, বারবার কল করার বিষয়ে কলার মনে করে, কোনো কারণে কলটা মিস হয়ে গেছে বা কলটা নোটিস করেনি। যেহেতু প্রয়োজনটা তার, সেহেতু তিনি বারবার নোটিফাই করার চেষ্টা করেন। এ ধরনের একটা মানসিক ব্যাপার থাকে। তারা মনে করেন, বারবার কল দিলে হয়তো অন্যপাশের ব্যক্তিকে পাওয়া যাবে। আবার অনেকের মাঝে একটু উদ্বেগের প্রবণতাও থাকে। যারা একটু বেশি উদ্বেগে ভোগেন, তাদের মাঝে দেখা যায়, যখন ফোনটা তিনি করলেন, তখন মনে হলো যে ফোনটা তার করতেই হবে। যে পর্যন্ত ফোনটা না করতে পারেন বা একসেস করতে না পারেন; সে পর্যন্ত তার মাঝে অস্থিরতা কাজ করে। এই অস্থিরতা বা এনজাইটি থেকেই তিনি বারবার কল দিতে থাকেন। এই এনজাইটির কারণেই আরেকজন ব্যক্তি বিরক্ত হচ্ছেন কি না বা গ্রাহক কোন অবস্থায় আছেন বা বিজি আছেন কি না, সেটা কলার বুঝতে পারেন না। বিশেষ করে যারা অল্পতেই স্ট্রেসআউট হন বা যাদের উদ্বেগজনিত সমস্যা আছে, তারা অনেক সময় বুঝতে পারেন না, তারা কাউকে বিরক্ত করছেন কি না।
বিনা অনুমতিতে কল দেওয়া কিংবা অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে ম্যাসেঞ্জার-হোয়াটসঅ্যাপ-ভাইবার-টেলিগ্রাম-ইমোতে কল দেওয়ার বিষয়ে ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘এটা খারাপ মানসিকতা। আসলে সোশ্যাল মিডিয়ায় কল করার বিষয়টির প্রচলন খুব বেশিদিন হয়নি। এক থেকে দুই বছরের মধ্যে যখন মোবাইল ডাটা ব্যবহারের বিষয়টি এসেছে, তখন থেকে অল্প টাকায় কল করার বিষয়টি চলে এসেছে। এটা যেহেতু খুব বেশিদিন ধরে শুরু হয়নি, তাই এর যে একটা নর্মস থাকে, এটা বেশিরভাগ মানুষই বুঝতে পারে না। অন্য আরেকজনকে ভিডিও কল করলে যে তিনি বিব্রত হতে পারেন বা বিরক্ত হতে পারেন কিংবা তিনি চান কি না, এসব বিষয় বোঝার মানসিকতা অনেক সময়ই অনেকের হয়ে ওঠে না। আর অনেকের মাঝে এ রকম প্রবণতা থাকে, আমার প্রয়োজন আমি কল করবো, আমার যেটা সুবিধা সেটাকেই প্রাধান্য দেই৷ এই ধরনের আচরণের কারণে অন্য কারও যে প্রাইভেসি ক্ষুণ্ন হতে পারে, সেই কাণ্ডজ্ঞানের অভাব আছে আমাদের দেশে।
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী দিলরুবা শারমিন বলেন, ‘প্রথম বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা সরাসরি কলের বিষয়ে কোনো আইন নেই। তবে সামাজিক ব্যাপারটা তো আইনেরও ঊর্ধ্বে। আমি একজন আইনজীবী আমার কাছে কল আসতেই পারে। তবে, আমাদের দেশের মেয়েরা মোবাইল নিয়ে খুবই বিড়ম্বনায় থাকে। মোবাইল রিচার্জ করতে গেলেও তারা নানা রকম শ্রীহীন কল পেয়ে থাকেন, একইসঙ্গে আত্মীয় স্বজন তো যেকোনো সময় সময়জ্ঞান নেই, সময়ে-অসময়ে পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই কল দিয়ে থাকেন। আননোন নম্বর থেকেও হ্যারেসমেন্টের বিষয়টা তো রয়েছেই। আননোন নম্বর থেকে কল আসার বিষয়টি মেয়েদের কাছে রীতিমতো আতঙ্ক। তবে, আমাদের দেশে এই বিষয়ে কোনো আইন নেই।’
দিলরুবা শারমিন আরও বলেন, ‘মানুষতো চটে যায় শেষ পর্যন্ত। আমার বয়স ৫৩। আমি একজন প্র্যাকটিশনার লইয়ার। আমি যখন একটা মানুষকে কল কেটে দিয়ে মেসেজ করি আমি ব্যস্ত আছি বা কোর্টে আছি, আপনি আমাকে একটু পরে ফোন দেন। তারা বোধহয় মেসেজগুলো খুলেও দেখেন না। কন্টিনিয়াসলি কল দিতেই থাকে। ধরার পর তারা রীতিমতো ঝাড়ি দিয়ে বসেন। বুঝতে চেষ্টা করেন না, আমি রাস্তা পার হচ্ছি, না গাড়িতে উঠছি, না কি গাড়ি থেকে নামছি, কোর্টে আছি নাকি গোসলে আছি নাকি রান্না করছি। আর আননোন নম্বর থেকে কল এলে তারা নিজেদের পরিচয় একেবারেই দিতে চান না; উল্টো তারাই জানতে চান, ‘আপা আপনার নাম কী, বাড়ি কোথায়, দুলাভাই কী করে, বাচ্চারা কী করে?’ এসব তথ্য তারা নেওয়ার চেষ্টা করেন।’’
এক প্রসঙ্গে জবাবে এই আইনজীবী বলেন, ‘‘আমি আসলে ফোন মিস করলে ব্যাক করি। তবে মাঝে মাঝে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। আমি পরবর্তী সময়ে কল ব্যাক করলে বলে, ‘আপনি কে, কেন কল করেছেন? আমি আপনাকে চিনতে পারছি না।’ বিভিন্ন বিষয় বলার পর তাদের মনে পড়লে তারা বলেন, ‘ও আচ্ছা অন্য কেউ কল করেছিল আমার ফোন থেকে।’ অনেকে বাচ্চার হাতে মোবাইলফোন দিয়ে রাখেন, বাচ্চারা যখন তখন কল করে থাকেন। এটা পরিচিত মহলও করে থাকে। অপরিচিতরাও।’
‘বিনা অনুমতিতে কল দেওয়া কিংবা অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে অডিও-ভিডিও কল পেলে কেমন বোধ করেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবে দিলরুবা শারমিন বলেন, ‘বোঝাতেই পারি না, আমার বয়স ৫৩ বছর। আমি দুটি বড় বড় বাচ্চার মা। এখন তো আসলে সবার হাতে হাতে ফোন, অল্প টাকায় টাচ ফোন হওয়ায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের হাতেই মোবাইল ফোন। তাদের সবার আবার ফেসবুকও আছে। ৫ হাজার ফ্রেন্ডের মাঝে সব সময় সবাইকে খেয়াল করাও সম্ভব হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেকেই মেসেজ দেন, ম্যাডাম আইন বিষয়ে সাহায্যের প্রয়োজন ছিল, নম্বরটা যদি দিতেন। আইনজীবীরা সাহায্য করবে মানুষকে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নম্বর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কল দেন। আর অপ্রয়োজনীয় বিষয়েও কথা বলেন। আদতে তার কোনো প্রয়োজনই নেই।